জয় তন্ময়দের বাড়ি দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল। এটাই কী এদের বাড়ি! এ দেখি হুলস্থূল ব্যাপার। মাত্র দু’জনের এ রাজ প্রাসাদের প্রয়োজন কি? যে দেশের অধিকাংশ লোক খোলা আকাশের নিচে রাত কাটায়, সে দেশে মাত্র দু’জনের জন্যে এ জিনিসটার মানে কি! এই বাড়িটায় ক’টা রুম কে জানে। গোটা ত্রিশেক হলেও একেকজনের জন্যে পনেরোটা করে, কোন অর্থ হয়! আমি এক এক কাঠি ওপরে, আমারটাই সেরা, আমার মত কারও নেই, এই-ই কি কারণ?
বিশাল গেট বন্ধ। ডানপাশে ছোট্ট গার্ডরুম। পুরোদস্তুর পোশাকপরা চোয়াড়ে টাইপের এক লোক এমন ভঙ্গিতে বসে আছে, এখুনি বুঝি গোলাগুলি শুরু হয়ে যাবে। কাউবয়দের মত আবার কায়দা করে পিস্তল ঝুলিয়েছে। সামনের টেবিলে টকটকে লাল ইন্টারকম।
জয় অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ইয়ে, এটা তন্ময়দের বাসা তো?’
লোকটা কথা বলে কৃতার্থ করছে এমন ভাব করে বলল, ‘ইশতিয়াক সাহেবের কথা বলছেন কি?’
জয় একটু থমকাল। গার্ড শ্রেণীর লোকরা এভাবে গুছিয়ে কথা বলে ওর জানা ছিল না। থেমে থেমে বলল, ‘হ্যাঁ, ওর ডাক নাম তো তন্ময়।’
‘ডাক নাম টাম কি, ভাল নাম বললেই হয়।’
‘আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছিলাম।’
‘উনি কি বলেছেন আপনাকে আসতে?’
সামনের রেজিস্টারে চোখ বুলিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, ‘কই, কেউ দেখা করবে এরকম কোন নোট তো দেখতে পাচ্ছি না?’
জয়ের গা রাগে জ্বলে যাচ্ছে। রাগ চেপে বলল, ‘আমি বলিনি দেখা করতে বলেছে। আপনি বলুন ও আছে কি না।’
‘আরে, আপনি তো বড় ঝামেলা করছেন, উনি আছেন কিনা বলতে পারছি না।’
জয়ের মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে। পয়সাঅলারা অন্যদের অপমান করার কত যে ফন্দি-ফিকির বের করেছে এই ইয়ত্তা নেই। ছোট্ট নি:শ্বাস ফেলে ভাবল, তন্ময়ের জন্যেই চলে যাওয়া উচিত হবে না। রূঢ় গলায় বলল, ‘আমি তন্ময়ের বন্ধু। দেখুন ও বাসায় আছে কিনা। ও দেখা করতে না চাইলে যাব।’
লোকটা শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কি যেন ভাবল। ইন্টারকমে ভেতরে তার সমপর্যায়ের কারও সঙ্গে চার-পাঁচবার শুধু হুঁ-হুঁ করল। কথা শেষ করে চেয়ার পেছনে হেলিয়ে বেশ ক’বার দোল খেয়ে বলল, ‘ঘুমাচ্ছেন।’
‘ওকে একটু খবর দিলে-।’
‘ঘুম না ভাঙা পর্যন্ত খবর দেয়া যাবে না।’
'তাহলে এখন আমি কি করব?'
‘কি করবেন তার আমি কি জানি। পরে আসেন।’
‘আমি তাহলে এখানে বসে অপেক্ষা করি?’
‘এখানে অপেক্ষা করবেন কি, বাইরে থেকে ঘুরে আসেন।’
জয় রাগে জ্বলতে জ্বলতে একবার ভাবল জিজ্ঞেস করে দেখবে ফারুকী সাহেব আছেন কিনা। ভাবনাটা বাতিল করে দিল। তন্ময় ওর বাবার সঙ্গে ওকে দেখে ফেললে দুয়ে-দুয়ে চার মিলিয়ে ফেলবে।
আচ্ছা, এ মুহূর্তে ওকে কি গ্যাং স্টারদের মত দেখাচ্ছে? অলক্ষে মুখে হাত বুলালো, আজ অবশ্য শেভ করা হয়নি। ও যখন শেভ করবে ভাবছিল তখন বাথরুমে ইভা ঢুকে গেল, আধঘন্টা লাগিয়ে গোসল করল। পরে আর শেভ করার কথা মনেই রইল না।
গার্ড লোকটার ভাব দেখে মনে হচ্ছে গোটা বিশ্ব এর পদতলে। এ সম্ভবত অপরিচিতদের সঙ্গে জঘন্য আচরণ করে সুখ পায়। কে জানে, একে হয়তো রাখাই হয়েছে এসব শিখিয়ে।
‘দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন, যান ঘুরে আসেন।’
জয় আর একটাও কথা না বলে বেরিয়ে এলো। বিড়বিড় করে বলতে থাকল, তন্ময়ের সঙ্গে দেখা না করে যাব না-যাব না। আশেপাশে একটা চা-র দোকানও নেই। এক কাপ চা খেয়ে অনেকক্ষণ সময় কাটানো যেত। সিগারেট ধরিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকল। ঘড়ি দেখল, প্রায় চারটা। চারটা বিশ পর্যন্ত হেঁটে ফিরে আসবে, এরিমধ্যে সাড়ে চারটা বেজে যাবে। তখনও তন্ময়ের ঘুম না ভাঙলে আবার ‘কম্বল প্যারেড’। বারিধারার এ পাশে চারদিকে মহা উৎসাহে কন্সট্রাকশনের কাজ হচ্ছে। এসব বিলাসবহুল বাড়ি শেষ না করেই অনেকে মারা যাবে। কেউবা কাজ শেষ করতে গিয়ে গোল্ড স্মাগলার হয়ে যাবে। এ দেশ এখন কোটিপতি বানানোর মেশিন হয়ে গেছে। পাকিস্তান আমলে শুনত বাইশ পরিবারের কথা। চুরাশির দিকে জানল, চারশো জন। ওই দিন পত্রিকায় পড়ল, গত বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী কোটিপতির সংখ্যা আঠারোশো জন। আরও কত আছে কে জানে!
এদের মধ্যে কি পঞ্চাশ জনও পাওয়া যাবে যে সৎ উপায়ে কোটিপতি হয়েছে? সৎ থেকে কি আদৌ সম্ভব? একজন লোকের বেঁচে থাকার জন্যে কত টকা প্রয়োজন? পাশ থেকে একজন রিকশাঅলা জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইজান, যাইবেন?’
জয় নিঃশব্দ হাসিতে মুখ ভরিয়ে মাথা নাড়ল। লোকটা যেতে যেতে ফিরে তাকাল। অপুষ্ট কালো মুখে কৃতজ্ঞতা চুঁইয়ে পড়ছে। এরা কত অল্প পেয়ে তুষ্ট হয়, সুখী হতে যেটা প্রথম শর্ত। এরা কি সুখী? কে জানে!
জয় ভাবল, এদের সম্বন্ধে আমরা কত কম জানি! ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে দেখি আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় অথচ সংখ্যায় এরাই বেশি, এদের সম্বন্ধে কিছুই জানা হয় না। লেখকরা এদের নিয়ে লিখতে গিয়ে এমন জটিল করে লিখবেন, পাঠক আগ্রহ নিয়ে পড়বে না। এটা সম্ভবত এসব লেখকরা ইচ্ছা করেই করেন। আর্ট ফিল্মগোছের কিছু একটা বানাতে গিয়ে লেজে-গোবরে করে ফেলেন।
চারটা পঁচিশ। জয় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ফিরতে লাগল।
গার্ড হড়বড় করে বলল, ‘কোথায় গেছিলেন? কে খোঁজ করল ছোট সাহেব জানতে চাইছিলেন। নাম বলেন নাই কেন?’
জয় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘জিজ্ঞেস করেন নাই, সেজন্য বলিনি।’
‘কি নাম আপনার?’
‘আপনাকে বলার প্রয়োজন দেখি না, তন্ময়কে দিন কথা বলব।’
গার্ড নিতান্ত অনিচ্ছায় রিসিভারটা এগিয়ে দিল।
‘তন্ময়, জয় বলছিলাম।’
‘ওরে হারামজাদা, তুই!’
‘থ্যাঙ্ক গড, তোর ঘুম ভাঙল তাহলে!’
‘মানে, এখুনি এসে তুই জানলি কেমন করে রে বেটা!'
'এইমাত্র না, চারটায় এসেছি। গার্ড বলল, তুই ঘুমিয়ে আছিস এখন ডাকা যাবে না। এখানে অপেক্ষা করতে চাইলাম, নিষেধ করল। ভবঘুরের মত রাস্তায় ঘুরে এইমাত্র ফিরলাম। এই সব শিখিয়ে লোকজন রাখিস নাকি?’
ওপাশে কবরের নিস্তব্ধতা। জয় উঁচু গলায় বলল, ‘হ্যালো, তন্ময়, হ্যালো।’
তন্ময় হিমশীতল গলায় বলল, ‘গার্ড যে বলল একজন দেখা করতে চাইছিল, সে তাহলে তুই। হাত দিয়ে দেখ তো তোর চোখে চশমা আছে কিনা?’
জয় বিরক্ত হলো, ‘আজেবাজে কথা বলছিস কেন!’
‘খামোশ শুয়ার! হাত দিয়ে দেখ চশমা আছে কিনা!'
‘হাত দিয়ে দেখতে হবে না, আছে। ঘুমানোর সময় ছাড়া সব সময়ই পরি।’
‘তুই যখন গার্ডের সঙ্গে কথা বলছিলি তখনও কি চশমা ছিল?’
‘আহ তন্ময়, কি ছেলেমানুষী, বললাম না ঘুমানোর সময় ছাড়া...!’
‘চোপ রাও, শুয়ার কাহিকা, যা বলেছি তার উত্তর দে।’
‘আরে পাগল, আমি কি চশমা ছাড়া কিছু দেখি? ছিল, তো কি হয়েছে?’
‘হয়নি কিছু। কেউ খোঁজ করছে জেনে আমার মনে হলো তুই হতে পারিস। কেউ তো আর আসে না। শুয়োরের বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করলাম, নাম বলতে পারল না। জিজ্ঞেস করলাম চোখে চশমা ছিল কিনা, কুত্তার বাচ্চা বলল, ছিল না।’
‘বাদ দে তো এসব।’
তন্ময় গরগর করে উঠল, ‘একচুল নড়বি না, জাষ্ট লাইটপোস্ট। আমি আসছি।’
জয় আড়চোখে দেখল লোকটা কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে, এপাশের কথাগুলো শুনেছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, ‘বসেন এখানে।’
জয় বসল না। দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করতে লাগল। দড়াম করে গেটের ছোট খুপরি আছড়ে মারার শব্দ হলো। ছোট হাফপ্যান্ট, ঢোলা গেঞ্জিপরা তন্ময়কে দেখে এ মুহূর্তে অবিকল বাংলা ছবির দৈত্য লাগছে। পোশাক-আশাক অন্যরকম এই যা। গেঞ্জিটা কোত্থেকে জোগাড় করেছে কে জানে! দেখে মনে হচ্ছে মশারীতে দু’টা হাতা লাগানো হয়েছে। হাসি পাচ্ছে। হাসতে গিয়েও হাসল না। দৈত্যর ভাবসাব সুবিধের না। চোখ মুখ দিয়ে ভাপ বেরুচ্ছে।
‘এই, গার্ডের বাচ্চা গার্ড, এর চোখে চশমা দেখা যাচ্ছে?’
‘ভুল হয়ে গেছে, স্যার।’
‘ভুল হয়েছে বলছিস, ভাল। আমাকে ডেকে দেস নাই কেন?’
‘স্যার, ভু-।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, এটাও তাহলে ভুল হয়েছে।’
এর কান্ড কারখানা দেখে জয় বিব্রত হয়ে বলল, তন্ময়, বাদ দে তো।’
‘চোপ! কথার মাঝে কথা বললে ফট করে মাথাটা ভেঙে ফেলব। তো, গার্ড সাহেব, এ এখানে অপেক্ষা করতে চেয়েছিল, হাঁকিয়ে দিলি কেন?’
গার্ড তো-তো করে বলল, ‘সা-স্যার, অপরিচিত লোক... আমার সঙ্গে আর্মস আছে, সিকিউরিটির একটা ব্যাপার-।’
‘এ তোকে বলে নাই, এ আমার বন্ধু?’
‘বলেছেন, স্যার, আপনি মানে আমি ভাবলাম-।’
তন্ময় ঘর কাঁপিয়ে বলল, ‘ভেবেছেন সিকিউরিটি তো? এই আর্মস আমি তোর পেছন দিয়ে ঢুকিয়ে দেব। তাহলে দেখবি সিকিউরিটি ঠিক থাকবে।’
জয় গায়ের জোরে সরিয়ে নিয়ে এলো। একটা দৈত্যকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিয়ে আসা চাট্টিখানি কথা না, প্রচুর কাঠ-খড় পোহাতে হলো। এরই মধ্যে ঘেমে গোসল হয়ে গেছে। তন্ময় পাগলের মত বিড়বিড় করছে, ‘বানচোত, আর্মস-এ মরিচ মাখিয়ে দিলে টের পাবি!’
‘ছি, কিসব বলছিস, এই সব বিশ্রী কথা বলতে নেই। তাছাড়া আমাকে চেনে না ঠিকই তো বলেছে। শুধু ধুধু লজ্জায় ফেলে দিলি। ছি!’
এবার রাগ গিয়ে পড়ল জয়ের ওপর। তন্ময় হিসহিস করে বলল, ‘তোকে আমার পছন্দ না। তুই মেয়েমার্কা ছেলে, আরবের শেখরা...।’
জয় হাসি চাপল। ‘আজ সকালেই একবার বলেছিস। আমার মনে আছে, লালা ঝরবে। এবার দয়া করে ঠান্ডা হ।’
দৈত্যটার ঠান্ডা হওয়ার কোন নমুনাই দেখা যাচ্ছে না। থেকে থেকে এর গা কাঁপছে। একে আটকে রাখতে জয়ের বেগ পেতে হচ্ছে।
*কনক পুরুষ, ৬: http://www.ali-mahmed.com/2010/08/blog-post_09.html
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Sunday, August 8, 2010
কনক পুরুষ: ৫
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
1 comment:
একটা সময় ছিল, যখন সেবা প্রকাশনীর (এবং এদের সিস্টার-কন্সার্ন প্রজাপতি প্রকাশনের) বই হলেই চোখ বুজে কিনে ফেলতাম। নির্ভরতার এই জায়গাটা তাঁরা তৈরি করেছিলেন। মনে আছে, কনকপুরুষ কিনেছিলাম অন্য একটা উপন্যাসের শুরুতে এঁদের প্রকাশিত উপন্যাসের তালিকা দেখে। অনেক অসাধারণ লেখকের (খবরদার, একদম বিনয় করবেন না! :)) লেখার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। নিয়াজ মোরশেদ, আসাদুজ্জামান, জাহিদ হাসানদের অনুবাদের কাছে কোথায় লাগে কাজী শাহনূর হোসেনের অনুবাদ? আবদুল হাই মিনারের 'জামশেদ মুস্তফির হাড়'-এর মত আরেকটা বই আর দেখলাম না! সেলিম হোসেন টিপু মুগ্ধতা তৈরি করেছিলেন 'গুণ্ডা', 'শোধ নেবে?' প্রভৃতি বই দিয়ে, পরে এই লেখকের আরও বই পড়েছি অন্য প্রকাশনী থেকে। রোকসানা নাজনীন কেন যে আর লেখেন না! আজকের পাঠকের কাছে এই নামগুলো কি পরিচিত?
এমন কি তিনগোয়েন্দা খ্যাত রকিব হাসানও সেবাকে ছেড়ে চলে গেছেন!
Post a Comment