পূর্বের কোন লেখায় আমি লিখেছিলাম, "আমাদের সবার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে একটা শিশু এবং একটা পশু। এদের মধ্যে মারামারি লেগেই থাকে হরদম। কখন যে কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে এটা বলা মুশকিল"।
এই পশুটাকে কাবু করার জন্য আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। আমরা আমাদের অর্জিত সমস্ত জ্ঞান ব্যয় করি এর পেছনে, এটা অবশ্য অন্ধকারে অচেনা ঢিল ছোঁড়ারই নামান্তর!
আমাদের বলতে আমি সাধারণদের বোঝাচ্ছি। সাধু-টাধুদের এই হ্যাপা নেই কারণ এদের মধ্যে আবার লুকিয়ে থাকবে কে, এরা নিজেরাই তো থাকেন লুকিয়ে, লোকচক্ষুর অন্তরালে!
স্টেশনের স্কুলটা [১] নিয়ে আমাকে হিমশিম খেতে হয় কারণ এখানকার কিছু শিক্ষার্থী আছে যাদের নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব। তবুও আমি ঝুলে থাকি, যতদিন পর্যন্ত চেষ্টা করা যায়। টিচারের পক্ষে এদেরকে সামাল দেয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে, নিয়ম করে আমাকেও থাকতে হয়। তিনটা স্কুলের মধ্যে কেবল এই স্কুলটাতেই শেখাবার বেলায় সরাসরি যুক্ত থাকতে হয়। সত্যি বলতে কি, আমার খারাপ লাগে না; সময়টা উপভোগ করি।
আরেকটা কারণ আছে, এই স্কুলে এখন পর্যন্ত ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯২! যদিও প্রতিদিন উপস্থিতির সংখ্যা অনেক কম, গড় হবে সম্ভবত ৪০। একজনের জন্য খানিকটা কঠিন হয়ে যায়, কেবল সংখ্যার কারণে না, একেকজনের পড়া একেক রকম। কেউ অ-আ; তো কেউ সানডে-মানডে।
এর নাম খোকন। এই ছবিটা ওর স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময়কার। তখন আমি এদের সবার ছবি উঠিয়ে একটা ডাটাবেইজের মত বানাচ্ছিলাম। কেবল এদের নাম-ধামই না, কার আচরণ কেমন, কার জন্য আলাদা করে কোনটা করা প্রয়োজন, কে নেশা করে, কে ড্যান্ডিতে আসক্ত ইত্যাদি।
খোকন নামের এই ছেলের বিরুদ্ধে এখানকার শিক্ষক আমাকে বেশ কবার বলেছেন, একে নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। গতকাল এ শিক্ষকের প্রতি এমন অভব্য-অসভ্য আচরণ করেছে যেটা আমি নিজের চোখেই দেখলাম।
মাত্র এদের স্কুল ড্রেস দেয়া শুরু হয়েছিল আজই এ স্কুল ড্রেস গায়ে দিয়ে এসেছে। আমি একে বললাম, স্কুল ড্রেস রেখে স্কুল থেকে চলে যাও, আর স্কুলের আসবে না। এ স্কুল ড্রেস দিয়ে চলে গেল। আমার মতে, একে স্কুল থেকে বের করে দেয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত। একজন-দুজনের জন্য গোটা স্কুলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা চলে না। এটা আমি করতে পারি না তাহলে অন্য অনেক বাচ্চার সঙ্গে অন্যায় করা হয়।
ঘটনা খুবই সহজ-সরল কিন্তু..., একটা কিন্তু থেকে যায়...। ক্রোধে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম বলেই হয়তো তখন এটা লক্ষ করিনি!
পরে মাথায় আটকে গেল। একটা ছেলে খালি গায়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে আমার চোখে কেবল এই দৃশ্যটা স্থির ছবির মত জমাট বেঁধে আছে। আর কিচ্ছু না...।
গতকাল আমার জরুরি লেখাটা, 'রূপগঞ্জ' নিয়ে লেখার কথা কিন্তু লিখতে ইচ্ছা করছিল না, একদম না। বছরের-পর-বছর ধরে আমি প্রায় প্রতিদিনই কিছু-না-কিছু লিখি। বাইরে কোথাও গেলে, বা অসুস্থ, অথবা অসম্ভব মনখারাপ না-থাকলে এর ব্যত্যয় হয় না। বিগত দুই বছরে আমাকে অনেক প্রতিকূলতা সামাল দিতে হয়েছে কিন্তু নিয়ম করে লেখা হয়েছে। অনেক বড়ো বড়ো সমস্যা আমার লেখাকে কাবু করতে পারেনি। মাথার উপর ভয়াবহ বিপদ নিয়ে আমি লিখে গেছি কারণ যখন লিখি তখন জাগতিক বেদনা আমাকে স্পর্শ করতে পারে না কিন্তু গতকালের দিনটা ছিল অন্য রকম। কেবল এই দৃশ্যটা, একটা ছেলে খালি গায়ে...।
একে স্কুল থেকে বের করা নিয়ে আমি বিচলিত না, আমার ধারণা এটা সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু...।
এটা আমি কি করলাম? আমি তো এটাও বলতে পারতাম, তুমি কাল স্কুলে এসে ড্রেসটা জমা দিয়ে যাবে। আর একটা স্কুল ড্রেস একজন না-দিলেই কি? আকাশ তো আর খানিকটা নীচে নেমে আসত না!
লেখা গেল নরকে! রাত বাজে এগারোটা, আমি স্টেশনের দিকে হাঁটা ধরি। আমি জানি, এ গাড়িতে পানি বিক্রি করে। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও এর কোন হদিশ বের করতে পারি না। এ কোথায় আছে কেউ কোন খোঁজ দিতে পারল না।
আমি রাতে একে পাওয়ার আশা ছেড়ে দেই। আজ সকালে তিনবার স্টেশনে চক্কর লাগিয়েও এর নাগাল পাওয়া গেল না। চতুর্থবার একে পেয়ে যাই।
আমি কোন ভনিতা না করেই বলি, কাল তুমি খুব খারাপ আচরণ করেছ, তোমাকে স্কুলে রাখা হবে না এটাই সিদ্ধান্ত কিন্তু কাল আমি তোমার ড্রেস রেখে দিয়েছি, তুমি খালি গায়ে স্কুল থেকে গেছ এর জন্য আমার মন খারাপ, খুব খারাপ। আমি এই অন্যায়ের জন্য অনুতপ্ত, তোমাকে এটা বলার জন্য কাল রাত থেকে তোমাকে খুঁজছি। আর তোমার জন্য আমি কয়েকটা কাপড় নিয়ে এসেছি এখান থেকে যেটা পছন্দ হয় তুমি বেছে নিতে পারো।
খোকন এটা বেছে নিয়ে গায়ে দেয়। নিজে থেকেই বলে, স্যার, আমারে কি সুন্দর লাগতাছে?
ঝাপসা চোখে আমি বিড়বিড় করে বলি, হ, সুন্দর, খুব সুন্দর। দাঁড়াও তুমার একটা ছবি তুইলা দেখাই। এই দেখো, কেমন, সুন্দর হইছে না?
চলে আসার সময় খোকন ইতস্তত করে বলে, আমার টেকা কি পামু না, স্যার?
আমার মনে পড়ে এ টিচারের কাছে বেশ কিছু টাকা জমিয়েছিল। ঝাপসা খোকনের দিকে তাকিয়ে আমি বলি, অবশ্যই পাবা। এটা তো তোমার টাকা। তোমার যেদিন প্রয়োজন হবে নিয়ে যাবা। দেইখো, আজেবাজে খরচ করবা না কিন্তু। তুমি না সমুসার ব্যবসা করতে চাইছিলা। এই ব্যবসাটা শুরু করো, আরও টাকা লাগলে বইলো, একটা ব্যবস্থা হইব।
খোকনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি হেঁটে হেঁটে ফিরে আসছি। যথারীতি আমার সঙ্গে পশুটাও। পশুটা অচেনা কিন্তু এর গায়ের গন্ধটা যে বড়ো চেনা। এর কাছ থেকে নিস্কৃতি নেই। পশুটার এখন নিস্তেজ চোখ কিন্তু আমি জানি অপেক্ষা করতে এর কোন ক্লান্তি নেই, এর কোন তাড়া নেই। সময়ে এ ঠিক ঠিক লাফিয়ে পড়বে, সর্বশক্তিতে...।
সহায়ক লিংক:
১. স্কুল, তিন: http://tinyurl.com/327aky3
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Wednesday, October 27, 2010
পশুটার গায়ের গন্ধ
বিভাগ
আমাদের ইশকুল: তিন
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
2 comments:
আপনার লেখনি শক্তিতে মুগ্ধ হলাম। অসাধারন লেখেন আপনি।
কী জানি!
আমি তো কেবল আমার ভেতরের অচেনা পশুটার কথা লিখতে চেষ্টা করেছিলাম...। @রুবাইয়্যাত
Post a Comment