আজ আমি জার্মানি ছেড়ে যাচ্ছি। আবারও আরাফাত-মায়াবতী দম্পতির হ্যাপা। আমাকে ডুজলডর্ফ এয়ারপোর্টে রেখে আসতে হবে। আমার মনে হয় এই দম্পতি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। এই দুই দিনে আমার কারণে এঁদের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। মানুষ কাঁহাতক সহ্য করতে পারে!
লাগেজ গোছানো আমার জন্য বিরাট এক ঝামেলার কাজ। কোথাও গেলে, সচরাচর আমি দু-একদিন আগে থেকেই গোছানো শুরু করি, ক্রমশ এর পরিধি বাড়তে থাকে। ছোটখাটো একটা ইস্ত্রিও আমি সর্বদা বহন করি কিন্তু এটা আমার কখনো কাজে লেগেছে বলে মনে পড়ে না! ব্যাগ যখন উপচে পড়ে তখন ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করতে গিয়ে জান বেরিয়ে যায়। পরে একটা সহজ বুদ্ধি বের করলাম। ব্যাগের চেইন লাগাবার পূর্বে কিছুক্ষণ এটার উপর বসে থাকা। অল কোয়ায়েট অন...সব ঠান্ডা, এরপর চেইন বাবাজীর না লেগে উপায় থাকে না!
এখন এখানে এতো সময় কোথায়? কিছুই কেনা হয়নি কিন্তু আরাফাত দম্পতি আমার বাচ্চাদের জন্য হাবিজাবি কি কি যেন দিয়ে দিয়েছে। তো, ব্যাগ উপচে পড়ার ঝামেলাটা যাবে কোথায়? আমি আরাফাতকে বলি, এটা তো মুশকিল হয়ে গেল দেখছি! এবার তো বসে কাজ হবে না, এটার উপর দাঁড়িয়ে গেলে কেমন হয়?
এঁরা আমাকে সরিয়ে নিজেরাই ব্যাগ গোছাতে লেগে যান। এঁরা কি কি করেন আমি জানি না দেখি ব্যাগ দিব্যি সুবোধ বালক!
আমি যেতে যেতে আবারও যতটুকু পারি দেশটাকে দেখার চেষ্টা করি, এখানকার লোকজনদের বোঝার চেষ্টা করি। আমার নতুন উপাধি 'ছিদ্রান্বেষি' চোখ দিয়ে অসঙ্গতি খুঁজে বেড়াই। বলার মত, লেখার মত তেমন কোন অসঙ্গতি আমার চোখে পড়ে না। ব্যাড, টু ব্যাড- হিটলারের দেশে এমনটা যে আমার কাম্য না। কেউ কেউ বলতে পারেন, মিয়া, তুমি মাত্র দুই দিনে কী ছাতাফাতা দেখলা? এদের সঙ্গে কুতর্কে আমি যাব না। যে লেখাটা আমি এক ঘন্টায় লিখি সেই লেখাটা বছরখানেক লাগিয়ে লিখলে চমৎকার একটা জিনিস দাঁড়াবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
এদের যে বিষয়টা আমাকে খুব টেনেছে সেটা হচ্ছে, 'ঈশ্বরের বিশেষ সন্তানদের' [১] [২] জন্যে এদের ভাবনা, ভালবাসা। বাস-ট্রামে দেখেছি এঁদের বসার জন্য আলাদা ব্যবস্থা, পারতপক্ষে এখানে কেউ বসে না। এঁদের সুবিধার্থে এমন কি বিশেষ ব্যবস্থায় বাসের কিছু অংশ কাতও করা যায়।
কিছু সীট দেখলাম ডাবল। আরাফাত আমাকে বলছিলেন, এটা খুব মোটা কোন মানুষ যদি উঠেন তাঁর জন্যে। রাস্তা পারাপারেরর সময় কেবল যে বাতির ব্যবহারই শেষ এমন না, নির্দিষ্ট লয়ে শব্দও হতে থাকে। আর এসব হবে না কেন? এই দেশের লোকজন তাঁর বেতনের ৪৫ ভাগ ট্যাক্স খাতে জমা দেয়।
অহেতুক দবদবা, অর্থ অপচয়ের নমুনা আমার চোখে পড়েনি। যেটা টেনেছে পুরনো স্থাপনার ছড়াছড়ি। কী চমৎকার করেই না এরা যত্ন করে ধরে রেখেছে এদের শেকড়কে। প্রত্যেকটা জায়গায় একটা ছন্দ আছে, সব নির্দিষ্ট ছন্দে চলছে। অতিশয়োক্তি নাই।
আমাদের যেমন বিশেষ বিশেষ দিনে, সময়ে উচ্ছ্বাসের চোটে প্রাণ বেরিয়ে যায় এমনটা না। ওহ, মনে পড়ল, আমার গায়ে ভাষাসংক্রান্ত ফতুয়া দেখে কেউ একজন বলছিলেন, আরে, আপনি দেখি শোকের মাস, ফেব্রুয়ারির জিনিস গায়ে দিয়ে বসে আছেন!
আমি তাঁকে বলেছিলাম, আমার অল্প জ্ঞানে আমি যেটা বুঝি, ভাষা হচ্ছে হৃদপিন্ড, সর্বদা ধুকধুক করে সচল থাকবে, বিশেষ মাস কী আবার! আর শোকের মাস কি, এটা তো অহংকারের মাস- এই দেশের সেরা সন্তানরা আমাদের শিখিয়ে গেছেন কেমন করে ভাষার জন্য, দেশের জন্য প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে অহংকার করার সুযোগ দিতে হয়।
তবে এটা আমি এখন বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে, যে কোন ভাবেই হোক, যে কোন কারণেই হোক, এই অনুষ্ঠানে না আসাটা বুদ্ধিমানের কাজ হতো না। অন্তত বাংলা ভাষার অপকার বৈ উপকার হতো না।
ডয়চে ভেলে ৩০টা ভাষা নিয়ে কাজ করে, বিশেষ একটা ভাষা নিয়ে আদেখলা দেখাবার সময় জার্মানদের নাই। বাংলা ভাষাটা ভালো পারলে এরা বাংলা বিভাগটাও নিজেদের লোক দিয়েই চালাতো। এরা যেটা ভাল মনে করে সেটাই করে কারও ধার ধারে না।
আমাদের অনেকের ধারণা, বাংলা বিভাগ বুঝি এখানকার হর্তকর্তা, বাংলা বিভাগ বললেই ডয়চে ভেলে কাত হয়ে যায়। ভুল, এমনটা না। ছোট-ছোট বিষয়েও আমি দেখেছি বাংলা বিভাগের লোকজনকে ছুটাছুটি করতে। এর ফল যে খুব একটা ফলপ্রসূ হয়েছে এমনটা আমার মনে হয়নি!
ডুজলডর্ফ এয়ারপোর্টে ঢুকে যাওয়ার আগে আমার কেবলি মনে হচ্ছিল, এখান নিয়ে টুকরো-টুকরো সুখ-স্মৃতিগুলো নিয়ে যাচ্ছি। এই স্মৃতিগুলো হয়তো আমি ভুলে যাব কিন্তু আমার মস্তিষ্ক ভুলবে না, ঠিকই মনে রাখবে। আমি চাই, বিভিন্ন সময়ে আমার এই সব জমানো সুখ-স্মৃতিগুলোর ক্রমশ ভারী হোক। আমি এও চাই, আমার মৃত্যুর সময় আমার মস্তিষ্ক সচল থাকুক, তখন এই সুখ-স্মৃতিগুলো একেক করে ভিড় করতে থাকুক। ওরা ওদের খেলা খেলতে থাকুক, আমি নিশ্চিন্তে অন্য ভুবনে যাত্র করি।
এয়ারক্রাফটে আমার পাশে আবারও একজন জার্মান। এর বয়স অনেক কম। ছটফটে। ফ্রেডরিক নামের এই ছেলেটা প্রথমেই আমাকে বলে নেয়, আমার ইংরাজি কিন্তু খুব খারাপ। আমি হেসে বলি, আমার ইংরাজি তোমার চেয়েও খারাপ। ফ্রেডরিকের সঙ্গে দুবাই পৌঁছার আগ পর্যন্ত বকবক চলতে থাকে। এ যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া ঘুরতে। আমি তাকে বলি, ধুর মিয়া, অস্ট্রেলিয়া কেন, বাংলাদেশে আসো। পৃথিবীর দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত এখানে, এখানে সুন্দরবন। তুমি আসলে আমি তোমার গাইড হবো।
ফ্রেডরিক চকচকে চোখে বলে, সত্যি, তাহলে নেক্সট ভেকেশনে তোমার দেশে আসব। ফ্রেডরিক হয়তো আসবে, হয়তো আসবে না; সেটা মূখ্য না।
এবার আমি খানিকটা নিশ্চিন্ত কারণ দুবাই এয়ারপোর্টে আমাকে থাকতে হবে মাত্র ২ ঘন্টা। চেক-ইন, চেক-আউট করতেই এই সময়টা চলে যাবে। এই নরকে [৩] আমার খুব বেশি সময় থাকার আগ্রহ নাই!
ঢাকায় আমি চলে আসি ২৪ জুন, সকাল নটায়, অনেকটা চোরের মত। ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। যেহেতু আমি একা তাই ভয়ে ভয়ে আছি, স্কুটারঅলা না আমাকে ফেলে দিয়ে আমার বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে উধাও হয়। আমি চোখ খুলে রাখতে পারছি না তবুও একটা বুদ্ধি বের করলাম, ব্যাটাকে বুঝতে দেয়া চলবে না যে আমি একটু পর পর ঘুমিয়ে যাচ্ছি। ঘুমটা একটু কাটলেই রাশভারী গলায় বলি, আহ, একটু দেইখ্যা চালাও, এক্সিডেন্ট করবা ।
ট্রেন ৩টায়। জার্মানি যাওয়ার পূর্বেই আমি ট্রেনের টিকেট কেটে নিয়ে গিয়েছিলাম। কাজটা বুদ্ধিমানের কারণ ঝটিকা সফরের পর ট্রেনে দাঁড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে যেত।
আমার জন্য অপেক্ষায় আছে বুড়া বাড়িটা [৪]। অতি দ্রুত এর কাছে আমাকে ফিরতে হবে। বুড়া আমার অপেক্ষায় আছে। সবাই আমাকে ফেলে দিলেও এ আমাকে ফেলে দেবে না...।
বৈদেশ পর্ব, বারো: http://www.ali-mahmed.com/2010/07/blog-post_05.html
সহায়ক লিংক:
১. ঈশ্বরের বিশেষ সন্তান: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post.html
২. ঈশ্বরের বিশেষ সন্তানদের জন্য আমরা কি প্রস্তুত: http://www.ali-mahmed.com/2010/05/blog-post_03.html
৩. বৈদেশ পর্ব, সাত: http://www.ali-mahmed.com/2010/06/blog-post_3252.html
৪. বুড়া বাড়িটা: http://www.ali-mahmed.com/2009/11/blog-post_24.html
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Monday, July 5, 2010
বৈদেশ পর্ব: তেরো
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
5 comments:
শুভ ভাই,
আপনার সুস্বাদু সিরিজটা পুরো পড়ে ফেললাম ... খুব ভালো করেছেন ফ্রেশ থাকতে থাকতেই লিখে ফেলে ... আর বাংলা ভাষার প্রতিনিধিত্বের জন্য আবারও অভিনন্দন
কলমবাজের কলম চলুক দুর্দান্ত গতিতে
পুরোটা পড়ে ফেলেছেন, বলেন কী! :) আপনার হাতে মনে হয় অফুরন্ত সময়। দাঁড়ান আপনাকে একটা কাজ গছিয়ে দেই। জাপানি ভাষায় ছোট্ট একটা লেখা অনুবাদ করে দেন।
ভয় পেলেন। হা হা হা। @ muquit
এই সিরিজটা নিয়ে একটা বই করা যায় কি?
বই তো করেন আমাদের প্রকাশক সাহেবরা। তাঁদের আবার প্রেমের উপন্যাস ব্যতীত অন্য লেখা প্রকাশের বেলায় আগ্রহ কম :)। @সুব্রত
আপনার ইমেইল আইডি দিলে ভাল হতো, আপনার আপত্তি না থাকলে।
alimahmed.bangladesh@gmail.com
এটায় জাস্ট একটা টোকা দিলেই আমি আপনার আইডিটা পেয়ে যাব। আবারও বলি, আপনার সমস্যা না হলে।
ভাল থাকুন। @সুব্রত
Post a Comment