Search

Monday, May 4, 2009

মাটির কাছাকাছি এক লেখক, মঈনুস সুলতান

 
সাহিত্য সাময়িকী টাইপের পাতাগুলো বিচিত্র কারণে দৌড়াদৌড়ি করে। সময়মত কখনই পড়া হয় না। অনেক দেরিতে হলেও মঈনুস সুলতানের 'চান সদাগরের ডিঙা' পড়ে আক্ষরিকার্থেই মুগ্ধ। লেখার ধাঁচ অনেকটা সৈয়দ মুজতবা আলীর মত।

যেটা খুব চোখে পড়েছে, তাঁর আছে লেখার ক্ষমতার বাইরে অন্য একটা ক্ষমতা।
যেটা আমাকে খুব টানে। 

একজন ভাল লেখক, ভাল গায়ক, ভাল প্রশাসক; পাশাপাশি তিনি একজন ভাল মানুষ কিনা? এটা খুব জরুরি। চালবাজ, ভানবাজ মানুষ সর্বত্রই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকেন। কে মাথার দিব্যি দিয়েছে কোন লেখক চালবাজ হবেন না? আর লেখক চালবাজ হলে এরচেয়ে ভয়াবহ আর কিছু নাই।

এখানে প্রাসঙ্গিক হবে বলে উল্লেখ করি, আহমদ ছফা বলছেন একজন লেখক প্রসঙ্গে, "প্রথম দিনেই একে দেখে আমার ভাল লাগেনি। মনে হয়েছিল ধূর্ত এবং লোভী একজন মানুষ। তবে তার পান্ডুলিপিটা পড়ে আমার অসম্ভব রোমাঞ্চ এসেছিল। বাংলা সাহিত্যের একটি ভাল লেখা, এমন একটা বইয়ের অপেক্ষা করছিলাম দীর্ঘ দিন। লেখককে ভাল না লাগলেও লেখকের সৃষ্টি আমাকে আপ্লুত করে দিয়েছিল।"

পরবর্তীতে আমরা দেখেছি এই ভানবাজ, চালবাজ লেখক মানুষটাকে। অধিকাংশ বিষয়ই তিনি কলুষিত করতে বাকী রাখেননি!

কিন্তু মঈনুস সুলতান মানুষটাকে আমার মনে হয়েছে টলটলে পানির মত। মানুষ যত উপরে উঠে তত সে শেকড়ের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। কেউ কেউ আপ্রাণ চেষ্টা করেন শেকড়ের কাছাকাছি থাকতে, চোখে চোখে রাখতে। অন্তত শেকড়কে দৃষ্টি সীমার বাইরে যেতে দেন না। সেই অল্প মানুষদের একজন তিনি, মাটিতে মাখামাখি হয়ে থাকা।

মঈনুস সুলতান থাকেন কাবুলে। জাতিসংঘের একটা কাজে মালয়েশিয়া গেলে থাকার ব্যবস্থা হয় একটা পাঁচতারা হোটেলে।
যেসব বঙ্গালরা পাচঁতারা হোটেলে উঠেন এদের একটাই কাজ থাকে, কেমন কেমন করে এটা প্রমাণ করা, যে তিনি জন্মের আগ থেকেই পাঁচতারা হোটেলে থেকে আসছেন।

কিন্তু এই মানুষটার চকচকে চোখ সাজানো-গোছানো হোটেল ছাড়িয়ে চলে যায় দূরে। লেখকের মুখেই শুনুন, "মালয়েশিয়ার রাজধানী সংলগ্ন নতুন শহর পুত্রজায়া। পাঁচতারা হোটেলের অদূরে পাহাড়ের ঢালে প্যাকিং বক্সের কাঠ, জং ধরা পামঅয়েলের টিন আর বাঁশের ছেঁড়া মাদুর দিয়ে তৈরি এক সারি ছোট ঘরে মোট ৪৭জন ভিসা-পারমিটবিহীন বাঙালি অভিবাসীর বাস।"

আমি লেখকের ঝকঝকে চোখ দিয়ে দিব্যি দেখতে পাই এই দেশের চাকা যারা বনবন করে ঘোরাচ্ছেন, সেই সব লড়াকু মানুষদের।
ওই মানুষরা অনেক সাহস করে মঈনুস সুলতানকে ধরে নিয়ে যান তাঁদের সঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের জন্য। এদের নেতাগোছের একজন যখন সত্যি সত্যি লেখককে তার কথামত আসতে দেখেন, তখন তাঁর উচ্ছ্বাস লেখক বর্ণনা করেন এভাবে, "তাঁর হাসি দেখে মনে হয়, আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনে স্যুটকেস হারিয়ে তা কেবল বরাতজোরে ফিরে পেয়েছেন।"
ওই মানুষটার নাম রশীদ মৃধা। ওই হাসির মালিক হচ্ছেন মৃধা নামের মানুষটা।

মঈনুসের লেখায় মুগ্ধ হয়ে এবং আখাউড়ার প্রসঙ্গ (জায়গাটার জন্য আমার রক্তে খানিকটা আলাদা নাচন আছে) আসায় মানুষটাকে মেইল করেছিলাম। ফিরতি মেইলে তিনি ব্যাখ্যা করেন প্রসঙ্গটা নিয়ে আসার কারণ।

মৃধা একটা ফাইভফিফটিফাইভের প্যাকেট খুলতে খুলতে বললেন,"ভাইজানের জন্য এই প্যাকেটটা কিনেছি, আপনি কি এইসব কম দামের জিনিস খাবেন?"
এখানে মইনুস সুলতান লিখছেন, "আমি যে একসময় দেদারসে বগুলা সিগ্রেট খেতাম, এ তথ্য চাউর করে দিতেই তিনি খুশী হয়ে বলেন, ...।"

মৃধা বলছেন, "...। এরা সকলে এই দেশে এসেছে টারজান ভিসায় ...এটা হইল জঙ্গলের লাইন, ঘোরতর অরণ্যের ভিতর দিয়া পলাইয়া পলাইয়া দেশ থেকে দেশান্তরে চইল্লা আসা। আমার ভিসার নাম আমি নিজেই দিছি- চান সদাগরের ভিসা। থাইল্যান্ড থাইকা মাছের ট্রলারে ভাইসা আসছি পিনাঙ দ্বীপ। 

বুঝলেন ভাইজান, এইবার আমারে কেউ ধরতেই পারেনি, ছিঁড়তেও পারে নাই কোন কেশ।"
আফসোস, আমাদের দেশের পশ্চাতদেশ উঁচিয়ে রাখা মানুষগুলো কখনও জানতেও পারবে না, টারজান ভিসা, চান সদাগরের ভিসায় কেমন করে একজন মানুষ প্রবাসে যান। কেমন করে এদের পাখির মত গুলি করে মেরে ফেলা হয়, ইঞ্জিন খুলে মাঝ-সাগরে ছেড়ে দেয়া হয়!

কাছেই সুদর্শন মসজিদ দেখিয়ে মৃধা মৃদু স্বরে বলেন, "...। 'দিলে একটাই খফ,...দেশের দুইডা ছেলে শবেবরাতের রাইতে এ মসিদে গেছিল, পুলিশ তাদের ধইরা কী যে করছে সেটা আপনারে কওয়ন যাইব না। আমি বরইতলির আবদুর রশিদ মৃধা, এ মসিদটারে সামনে রাইখ্যা নামায আমি এইখানেই পড়ি। কবুলের মালিক আল্লা-তালা। ভাইজান কিছু মনে নিয়েন না।'

এই বলে রশিদ মৃধা সেজদার জায়গায় রুমাল বিছিয়ে আসরের নামাযে উঠেন।"

এখানে আমার মত দুর্বল পাঠকদের চোখ জলে ভরে আসে। সামনের ঝাপসা স্ক্রিনে মৃধার মুখ কাঁপতে থাকে, উধাও হয়। ভেসে আসে মাহাথীর মোহাম্মদের মুখ। এই কী মাহাথীরের মত একজন অসাধারণ মানুষের রেখে যাওয়া মালয়েশিয়া? একটা অসভ্য ভাবনা-আচরণ...।
সভায় আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে একপর্যায়ে বলেন, "বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজদ্দৌলা তার সভাকবি বীরবলকে গানে গানে সারা ভূ-ভারতে নববর্ষের মহাত্মকীর্তন প্রচার করতে নির্দেশ দেন...। 
...একজন প্লাস্টিকের বেবি পিয়ানো বাজিয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠেন, 'খাঁ খা তোর বক্কিলারে কাঁচ্চা ধইরা খা'। "

এটা পড়ে হাসি চাপি। দামাল মানুষগুলোর পাগলামি দেখে মনে হয় একদৌড়ে ওই সভায় গিয়ে হাজির হই। আমিও হেঁড়ে গলায় তালে তালে বলি, খা খা খা, কাচ্চা ধইরা খা।

"অভিবাসী বাঙালীরা নববর্ষ উপলক্ষে খানাপিনার তোফা আয়োজন করেছেন। ঘরটি নিচু বলে আমরা রুকু সেজদার মতো শরীর বাঁকা করে ভেতরে ঢুকে মাদুরে বসি।"
পড়ে বুকের একদম ভেতর থেকে কষ্টের শ্বাস বেরিয়ে আসে। হায়রে, আমাদের দেশের অভাগা ছেলেরা- কেমন করে এদের পাঠানো রেমিটেন্সের টাকায় 'শিকখিত' স্যাররা বাবুগিরি করেন!

মঈনুস সুলতান নামের মানুষটাকে ঈর্ষা করি, মানুষটা জানেনও না, তিনি কী অসাধারণ একটা কাজ করেছেন। দেশের এই অভাগা মানুষগুলো জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন দেশের একফালি চাঁদ, ফালি ফালি করে কাটা। সেই চাঁদের আলো বুকে কপালে মেখে মানুষগুলো পার করে দেবেন দিনের পর দিন, মাস, বছর।

বেঁচে থাকলে দেশে ফিরে আসবেন। সন্তান, নাতি-পুতিদের কাছে হাত-পা নাড়িয়ে ঝলমলে মুখে গল্প করবেন, জানিস বেটা, আমরা যখন হেই দূর দেশে আছিলাম, আমগো এইখানে অনেক বড় একটা মানু আইছিল। কইলে বিশ্বাস করতি না, কী লম্ফা লম্ফা তাইনের চুল। আউলা বাতাসে ফুরফুর কইরা চুল উড়ে। মানুডা হাসে আর চুল উড়ে...।

1 comment:

Anonymous said...

লেখাটা পড়ে আমার ও চোখের কোণ ভিজে উঠে
ছিলো...