১৯৭১ সাল। তৎকালীন ক্যাপ্টেন এস এ ভূইয়া জবানীতে একজন 'অখেতাবধারী', দুলা মিয়ার কথা।
"২৬ বছরের, দুলা মিয়া। সমগ্র মুক্তিবাহিনীতে দুলার মত সাহসী যুবক আর কজন ছিল আমার জানা নেই। তেলিয়াপাড়া যুদ্ধে সে যে সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার তুলনা হয় না। বৃষ্টির মত গোলাবর্ষণেন মধ্যেও এই অকুতোভয় যুবক লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেনি কিংবা রণক্ষেত্র ছেড়ে দূরে সরে যায়নি।
...
২১ জুন রাতে শত্রুবাহিনী যখন আমাদের উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায় সেই একই সময় তারা কলকলিয়াতেও আক্রমণ চালায় (দুলা, ক্যাপ্টেন মোর্শেদের অধীনে যুদ্ধ করছিল)। মোর্শেদের সৈন্যরা শক্রদের সাথে সারারাত যুদ্ধ করে। কিন্তু শত্রুর সংখ্যা বহুগুণ বেশী থাকায় মোর্শেদের দল সেখান থেকে অবশেষে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
সে সময় দুলা মিয়ার হাতে ছিল একটা হালকা মেশিনগান। সে তার হালকা মেশিনগান দিয়ে অনবরত গুলি ছুঁড়ে যাচ্ছিল এবং শক্রুর অগ্রগতিকে সারারাত ব্যাহত করে রেখেছিল। নি:শঙ্কচিত্তে অপারবিক্রমে সে এক ভয়াবহ শক্রুর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিল।
অবস্থা বেগতিক দেখে যখন দুলা মিয়ার সংগীরা আত্মরক্ষা করতে পিছু হটছিল তখন দুলা পিছিয়ে না এসে নির্ভয়ে তার হালকা মেশিনগান থেকে গুলি ছুঁড়েই যাচ্ছিল।
তার অসমসাহসীকতা এবং গুলি ছোড়ার ফলে অন্যরা পিছু হটবার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু দুলার বড়ই দুর্ভাগ্য, সে অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে এক মহা বিপদে আটকা পড়ল। শত্রুপক্ষের মেশিনগানের এক ঝাঁক গুলি এসে তাকে বিদ্ধ করে।
... অবশেষে শত্রুরা দুলাকে আহত করতে সক্ষম হয়ে কিছুটা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলল।
কিন্তু নিদারুণ আহত অবস্থায়ও দুলা মিয়া গুলি চালানো বন্ধ করেনি। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রাণ দেবে কিন্তু জীবিত অবস্থায় ধরা দেবে না।
...
রাত ভোর হল। বেলা তখন ১১টা। সবাই ফিরে এল কিন্তু দুলা এল না। খবর এল, দুলার পেটে এবং ডান পায়ে কয়েকটি গুলি লেগেছে। সে কাদা-পানির মধ্যে অসহায় অবস্থায় পড়ে আছে।
...
অনেক চেষ্টায় উদ্ধার করে যখন দুলাকে আমাদের সামনে আনা হল তখনকার দৃশ্য এত করুণ এবং বেদনাদায়ক তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। মুমূর্ষু দুলা বাম হাত দিয়ে তার গুলিবিদ্ধ পেট চেপে ধরে আছে, কেননা ক্ষতস্থান থেকে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসার উপক্রম করছিল। ডান পায়ে গুলি লেগে ছিন্নভিন্ন মাংসগুলো কোনক্রমে পায়ের হাড়ের সংগে লেগে ছিল। আর তার সমস্ত শরীর রক্তে রঞ্জিত।
দুলা একটা গুলিবিদ্ধ বাঘের মত ছটফট করছিল। তখনও সে বাকশক্তি হারায়নি। আমাদের চোখের দিকে চোখ রেখে সে বলল, "স্যার, আমি আর বাঁচব না, এক্ষুণি মারা যাব। আমার আফসোস রয়ে গেল স্বাধীন বাংলার মাটিতে মরতে পারলাম না। ...আমাকে কথা দিন আমার লাশ স্বাধীন বাংলায় কবর দেবেন, আজ হোক কাল হোক দেশ স্বাধীন হবেই।"
আমাদের সবার চোখে পানি। সে আরও বলল, "স্যার, পাঞ্জাবী দস্যুরা যখন আমাদের বাঙালীদের নির্মমভাবে, নির্বিচারে হত্যা শুরু করে তখন আমার ৮ বছরের মেয়ে আমাকে কি বলেছিল, জানেন? 'বলেছিল, আব্বা, তুমিও মুক্তিফৌজে যোগ দাও, পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে লড়াই কর, দেশকে স্বাধীন কর'।"
আমার হাত ধরে দুলা মিয়া বলল, "স্যার আপনার বাড়ী কুমিল্লায়, আপনি নিশ্চয়ই কুমিল্লার শালদা নদী চেনেন? সেখানে আমার বাড়ী। দয়া করে আমার মেয়েকে এবং কাউকে আমার মৃত্যুর খবর দেবেন না। আমার মৃত্যুর খবর পেলে মেয়েটা আর বাঁচবে না। তবে আমার একটা দাবী, আমার হতভাগিনী মেয়েটিকে আপনি দেখবেন। স্যার, আমার এই একটি কথা ভুলে যাবেন না।"
দুলার এমন মুমূর্ষু অবস্থায় এ্যাম্বুলেন্স আসতে কিছুটা দেরী হবে মনে করে লে: কর্নেল শফিউল্লা (পরবর্তীতে সেনাপ্রধান) তাকে নিজের জিপে করে আগরতলা পিজি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন।
দুলার অবস্থা দেখে সেদিন আমার মত অনেকেই ধারণা করেছিল, দুলা আর বাঁচবে না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে দেড় মাস পর দুলা আরোগ্য লাভ করে ফিরে আসে এবং পুনরায় ক্যাপ্টেন মোর্শেদের কোম্পানি যোগদান করল। পরবর্তীকালে অসীম বীরত্বের সংগে দুলা অনেক রণক্ষেত্রে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে।
(বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১০ খন্ড, সশস্ত্র সংগ্রাম)
*ভাষারীতি প্রায় অবিকল রাখা হলো।
**পরে জানা যায় দুলা মিয়াকে কোন খেতাব দেয়া হয়নি!
আমার মাথায় কেবল ঘুরপাক খায় দুলা মিয়ার ওই মেয়েটি এখন কেমন আছে [১]? আরও প্রশ্ন, বীরশ্রেষ্ঠদের মধ্যে একজনও সিভিলিয়ান নাই। কেন?
কতটা সাহস দেখালে একজন খেতাব পায়? কতটা রক্ত ঝরালে একজন দেশপ্রেমিক হয়? কেমন ট্রেনিং নিলে একজন সিভিলিয়ান সামরিক মর্যাদা পায়? আর কেমন করেই বা মারা গেলে একজন বীরশ্রেষ্ঠ হয়?
***নির্বোধ আমরা কেবল এটা জানি না খেতাব না-দিলে কারও কারও কিছুই যায় আসে না [২]।
সহায়ক সূত্র:
১. দুলা মিয়ার সেই মেয়েটি...: http://www.ali-mahmed.com/2009/08/blog-post_05.html
২. একজন ট্যাংকমানব: http://www.ali-mahmed.com/2010/03/blog-post_03.html
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Wednesday, April 8, 2009
মুক্তিযুদ্ধে একজন 'অখেতাবধারী' দুলা মিয়া।
বিভাগ
১৯৭১: প্রসব বেদনা
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment