আমার স্পষ্ট মনে আছে, তখন হুমায়ূন আহমেদের তুমুল জনপ্রিয় এইসব দিনরাত্রি দেখাচ্ছিল। হুমায়ূন আহমেদ এক সাক্ষাৎকারে বললেন, আমার একটা কালার টিভি দরকার- এই টাকা হয়ে গেলেই...।
মোদ্দা কথা, ধারাবাহিকটা লিখছেন কালার টিভির প্রয়োজনে। এটা পড়ে নিমিষেই আমার বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল। কেবল মনে হচ্ছিল, মানুষটা কী মানুষ, না পিশাচ!
আজ বুঝি লেখকদের কেবল কপকপ করে জ্যোৎস্না খেয়েই দিন যায় না। এবং লেখকদের কোন অধিকার নাই তার প্রিয় মানুষদের সামান্য সাধ-আহ্লাদগুলোর জলাঞ্জলি দেয়ার।
আজ তাই আমার জানতে বাকি নাই লেখকের তুচ্ছ চাওয়া-পাওয়ার কথাটা চলে এলে একজন পাঠক কেমনটা বোধ করেন। লেখকের ধপধপে ইমেজে ছোপ ছোপ দাগ পড়ে যায়। মনে হয় মানুষটা কী লালচি-লোভী!
কি বলেন বাহে, হয় না, হয়?
আমাদের দেশে লেখকদের তার পাওনা-প্রাপ্যটুকু দেয়ার মনোভাব এখনও গড়ে উঠেনি। এমনকি ন্যূনতম সম্মানও। কোন পত্রিকায় লিখলে পত্রিকাওয়ালাদের ভাবখানা এমন, বাহে, এখানে যে লিখতে দিচ্ছি এই তো ঢের।
এটা আমরা মনে রাখার চেষ্টা করি না, কখনও পত্রিকার কারণে একজন লেখক দাঁড়িয়ে যান, তেমনি একটি পত্রিকাও লেখককে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
সালটা ৯২/ ৯৩। আমি তখন লিখছিলাম, এক্ষণ বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত (এদের দাবীমতে) একটি দৈনিকে। ‘একালের রূপকথা’ নামে লিখেছিলাম প্রায় দেড় বছর। ফি হপ্তা, প্রতি সপ্তাতে ১টা করে লেখা। প্রত্যেক লেখার জন্য পেতাম ৫০ টাকা করে। মাসে কত হতো, ২০০?
মজার ব্যাপার হচ্ছে টাকাটা আমাকে পাঠিয়ে দিলেই হয়। উহুঁ, সশরীরে নেয়ে আসতে হবে। হায়রে সশরীর! বডিটাকে ঢাকা পর্যন্ত নেয়াটা কী কম ঝক্কির, কম খরুচে ব্যাপার! তো, দুই তিন মাসের টাকা জমিয়ে গেলাম।
আবার সুকঠিন নিয়ম ছিল, মাসের ২১ তারিখ থেকে ২৪ তারিখে যেতে হবে। ২০ তারিখে গেলেও হবে না, আবার ২৫ আরিখ গেলেও হবে না। তো, গেলাম নির্দিষ্ট তারিখেই। হায়, তখন যদি বলা হয় ফান্ড নাই, কেমন লাগে? কি জানি কার কার কাছে ভাল লাগে- আমার নিজেকে ভিক্ষুক-ভিক্ষুক মনে হত!
আমার একবার মেজাজ খুব খারাপ হলো, রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল। ফকিরের আবার রাগ!
ওই পত্রিকার জন্যই একটা লেখা লিখলাম, ‘সহনশীল প্রাণী’ নামে। পত্রিকাওয়ালারা খুব রাগ করলেন। বিভাগীয় সম্পাদক বললেন, এইটা কি লিখেছেন? সম্পাদক সাহেব খুব রাগ করেছেন।
বিভাগীয় সম্পাদক নামের মানুষটাকে আমি পছন্দ করতাম, কথা হত খোলাখুলি। আমি বললাম, যা লিখেছি তা কি অসত্য?
বিভাগীয় সম্পাদক মিনমিন করে বললেন, তা না, কিন্তু ভাইরে সব সত্য কি আমরা বলতে পারি! আর আপনি এইসব লিখলে আপনার লেখা কি আর ছাপা হবে? ক্ষতিটা কার হবে, আপনার হবে না? তাছাড়া আপনার সমস্যাটা কি, আপনি কী টাকার জন্য চাল কিনতে পারছেন না?
আমি মনে মনে বললাম, আমার ক্ষতি হবে, কচু- আমার মতো অগাবগা না লেখলে ঘেঁচু হবে! মুখে বললাম, চাল কেনার কথা আসছে কোত্থেকে- এটা তো আলোচ্য বিষয় না! আমার প্রাপ্যটা দেয়া হবে না কেন? আচ্ছা, আপনি কি এটা বলবেন আমায়, একজন ফটো সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছবি উঠান অথচ আপনারা তাঁর নামটা পর্যন্ত দেন না; পত্রিকার নাম দেন কেন, এর কোন উত্তর আপনাদের কাছে নাই। আছে?
সুখের বিষয়, দীর্ঘ ১ মাস পর লেখাটা ছাপা হয়েছিল। ওই সময়কার তীব্র আনন্দ আমার স্মৃতিতে এখনও স্পষ্ট। কেবল মনে হচ্ছিল মফঃস্বলের অখ্যাত একজন অলেখকের বিশাল এক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিজয়।
একালের প্রলাপ থেকে ‘সহনশীল প্রাণী’ লেখাটি এখানে যোগ করছি।
"সহনশীল প্রাণী...
ভূত অপ্রার্থিব গলায় বলল, ‘এই আবর্জনা লেখক, তোকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম। ফাঁসি-টাসি না, জাস্ট একটানে মুণ্ডুটা ছিঁড়ে ফেলব।’
একজন লেখক অখ্যাত কুখ্যাত পরের কথা, কী সীমাহীন তার ক্ষমতা। ইচ্ছে হলেই একটা চরিত্র সৃষ্টি করে হাসান, কাঁদান- বিষণবোধ করলে মেরে ফেলেন। কাল্পনিক সৃষ্টির মিছে স্রষ্টার এ সম্বোধন ভালো না লাগারই কথা।
লেখক রাগ চেপে বলল, ‘ভাই ভূত, আপনি সভ্য না অসভ্য দেশের ভূত?’
ভূত দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ‘পেটা গাইল্যা ফালামু (এটার অর্থ হবে সম্ভবত এরকম, অমানুষিক শক্তি প্রয়োগে নাড়ী ভুঁড়ি ভর্তা করে ফেলা হবে)। রাস্কেল, ইউ নো, আমার গায়ে নীল রক্ত বইছে।’
লেখক: আ বেগ য়্যু’ পার্ডন স্যার। নীল রক্ত আপনি দেখি অতি সভ্য ভূত! তা আপনি স্যার একটু ভুল বললেন এখন আপনার ধমনীতে নীল রক্ত দূরের কথা, লাল-সবুজ-সাদা কোনো রক্তই এক ফোঁটা বইছে না।
ভূত (জাঁক করে): ইয়েস, সভ্য দেশের অতি সভ্য ভূত আমি।
লেখক: সভ্য দেশে মৃত্যুদণ্ড উঠিয়ে দেয়া হয়েছে অথচ আপনি দিচ্ছেন, এটা কি ঠিক হচ্ছে? তুই-তোকারি করছেন এটাই বা কেমন!
অতি সভ্য ভূত: তুই-তাই না করলে ভূতদের বাজার পড়ে যায়। তাছাড়া মানুষ নামধারী অমানুষদের বিচার করে মেরে ফেলতে হবে না, আশ্চর্য! পৃথিবীটাকে চমৎকার বানাতে গিয়ে মানুষকে নিষ্ঠুর হতে হয় যে।
লেখক: স্যার, আপনি বোঝাতে চাচ্ছেন মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করা। সৌদির মতো কিছু বর্বর দেশ অবশ্য এ বিষয়ে বহু এগিয়ে আছে। এরা স্টেডিয়ামের মতো বিশাল জায়গায় উন্মুক্ত শিরচ্ছেদের ব্যবস্থা করে। রেডিও টেলির্ভিশনে আগাম ঘোষণা দিয়ে টেলির্ভিশনে ঘটা করে দেখানো হয়। অবশ্য এরা দয়ার সাগর ঘোষণা করে দেয়, শিশু এবং অসুস্থ লোকজনকে যেন এ অনুষ্ঠান দেখতে না দেয়া হয়। দলে দলে লোকজন শিরচ্ছেদ দেখে। অপার আনন্দ লাভ করে।
অ. স. ভূত: ভালোই তো, অপরাধীদের জন্যে উদাহরণ সৃষ্টি হবে।
লেখক: ‘অপরাধীর পায়ের চেয়ে আইনের হাত লম্বা’ এটা অন্যভাবেও বোঝানো যায়। ভারতে অসংখ্য প্রাণ হরণকারী একজন ডাকাতকে ধরার জন্যে এক হাজার সামরিক, আধা-সামরিক কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছে। একে ধরতে গিয়ে এ পর্যন্ত পঁচিশ কোটি রুপী খরচ হয়েছে। ডাকাতের মাথার দাম ধরা হয়েছে চল্লিশ লাখ রুপী। একে আটকে মেরে ফেললে কি হবে? মৃত্যুর পর সবাই আনন্দ-বেদনার ঊর্ধ্বে? হেনরী শ্যারিয়ারের ‘প্যাপিলন’-এর প্যাপীকে ‘আইলস ডু স্যালুট’-এর নির্জন সেলে যে রকম আটকে রাখা হয়েছিল ওরকম অন্ধকূপে চরম অপরাধীদের আজীবন আটকে রাখা উচিত। মাঝে মধ্যে এদের সাক্ষাৎকার নিয়ে ফলাও করে জানানো যেতে পারে। প্যাপীলনের মতো এদেরও সময় থেমে যাবে মনে হবে এ কষ্ট পৃথিবীর কষ্ট না ।
অ. স. ভূত: দরিদ্র দেশগুলোর টাকা কই, ফটাফট মেরে ফেললেই তো সুবিধা?
লেখক: যে মানুষ তার মতো কাউকে সৃষ্টি করতে পারে না সে কোন অধিকারে একটা প্রাণ নষ্ট করবে। এসব থাক, এখন বলেন, আমাকে কেন মৃত্যুদণ্ড দিলেন।
অ. স. ভূত: তুই না কি আমাদের নিয়ে যা-তা লিখিস, লোকজন হাসি-ঠাট্টা করে। জন নামের একজন ভূতকে বলেছিস ‘রাম ছাগল ভূত’। এসব কি, অন্তত ‘জন ছাগল ভূত’ বললেও তো হতো। এসব ছাই ভস্ম লিখে মাল কামিয়ে লাল হচ্ছিস।
লেখক (বেদনাহত হয়ে): স্যার-স্যার, এমন কুৎসিত ভঙ্গিতে বলবেন না। লাল-নীল জানি না এরকম একটা লেখা লিখে পাই পঞ্চাশ টাকা।
অ. স. ভূত: পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কি করিস?
লেখক: এটা তো সম্মানী এ দিয়ে আবার কি করবো, বাঁধিয়ে রাখি। এটা সম্মানী তো তাই বিশেষ দিনে গিয়ে নিয়ে আসতে হয়। লেখককে সৌজন্য কপি দেয়ার নিয়ম নাই বিধায় ‘অসৌজন্য কপি’ কিনে নিজের লেখা নিজেই পড়ি।
এরা অন্য ভুবন থেকে এসে আলো দেখান- এতো আলো দেখিয়ে ফেলেন, আলোর ছটায় নিরূপায় হয়ে জানালা বন্ধ রাখতে হয়। প্রিয় মানুষদের ন্যূনতম সাধ-আহ্লাদের জলাঞ্জলি দিয়ে, ভরপেট খাবার খেতে, চকচকে পোশাক পরতে এদের কখনোই ইচ্ছা করে না- নিয়ম নেই। লেখক থাকবেন অপরিচ্ছন্ন, চুলে পাখি না হোক অন্তত তেলাপোকা ডিম দেবে, মদ্যপান করে ল্যাম্পপোস্ট রাস্তার মাঝখানে কেন এ নিয়ে তুমুল ঝগড়া করবেন, বড় বড় নোখ দিয়ে বেশ্যাকে খামচাবেন। এরা কপাকপ জ্যোৎস্না খান, সরষে তেলের মতো গায়ে জ্যোৎস্না মাখেন, জ্যোৎস্না রাত না হলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান না।
তবে হ্যাঁ, পাঠকের ভালোবাসার কথা যদি বলেন, তখন পৃথিবীর সব বেদনা তুচ্ছ মনে হয়। তখন মনে হয় জীবনটা এত ছোট কেন!
2 comments:
হায়, সব পত্রিকাঅলাদের এরকম মানসিক দৈন্যতা কেন? এ অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে, কেউ প্রকাশ করার সাহস দেখাতে পারেন, কেউ পারেন না। ‘একালের প্রলাপ’ বইতে লেখাটি পড়েছিলাম, আজ শানে নযুল পড়লাম। পত্রিকা ব্যবসায়ীদের এই অন্ধকার দিকগুলো প্রকাশ হওয়া দরকার, ভবিষ্যতে যাতে নতুন লেখকেরা অভিমানে নিজেদের গুটিয়ে না ফেলেন।
Post a Comment