Search

Thursday, June 28, 2007

আপনি মরে বেঁচে গেলেন, আমাদেরকে বাঁচিয়ে

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আর ২০০৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর- অনেকটা সময়। ৩৪টা বছর। ক্রমশ মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ খেলা হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা হয়ে যান খেলুড়ে।

এমনই একজন মুক্তিযোদ্ধা সুরুজ মিয়া। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়লগ্নে তিনি কি ভাবছিলেন? অন্য ভুবনের আনন্দ? সুরুজ মিয়ারা সেলিব্রেটি তো নন, যে আমরা এইসব মুখস্ত করে বসে থাকব!
আচ্ছা, ২০০৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোরে এই মানুষটাই দুম করে গলায় ফাঁস লাগিয়ে যখন ঝুলে পড়লেন তখনই বা কি ভাবছিলেন? এটাও কখনও জানা হবে না।
 

জীবনান্দ দাশের মানুষটার মরিবার সাধ আমি আজও বুঝিনি কিন্তু এই মানুষটা মরিবার কেন হলো সাধ, এটা খানিকটা বোধগম্য হয়। সুরুজ মিয়া মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন নিশ্চই। দারিদ্র, দীর্ঘ রোগভোগ, টাকার অভাবে সুচিকিৎসায় ব্যর্থতা, সরকারের দেয়া মুক্তিযুদ্ধ ভাতা বন্ধ হয়ে যাওয়া।
মানুষটা রাতের পর রাত পেটের অসহনীয় ব্যথায় জবাই করা পশুর মত চিৎকার করেছেন। সুচিকিৎসা হয়নি! সব মিলিয়ে ৩৫তম বিজয় দিবস এই মানুষটা কাছে কোন অর্থই বহন করেনি। সমস্ত জাতি যখন প্রস্থত হচ্ছিল বিজয় দিবস পালন করার জন্য- মানুষটা দুর্দান্ত অভিমানে চলে গেলেন। ভোরের মোলায়েম সূর্যটা মোটেও আকর্ষণীয় মনে হয়নি তাঁর কাছে।
 

প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছিল (এটা জানা গিয়েছিল প্রথম আলোর রিপোর্টে), তিনি যেহেতু আত্মহত্যা করেছেন, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর দাফন হবে না। মানুষটার লাশ ১২ ঘন্টা গাছে ঝুলছিল।

আমাকে যেটা বিস্মিত করেছিল, হতভম্ব করেছিল , রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর দাফন নিয়ে সংশয়ের বিষয়টি। এই সংশয় পোকাটির উৎস কোথায়- কোন নিতল থেকে উঠে আসে এমন ভাবনা। যারা এমনটা ভাবে, তাঁদের এই ভাবনার উৎস কী!

আমার কেবলি মনে হয়, খুব বড়ো একটা ফাঁক আছে কোথাও- এই ফাঁকটা বিস্তৃত হচ্ছে ক্রমশ। আমাদের এই প্রজন্ম দেখেছে, সরকারি কাস্টডিতে থাকার পরও জাতীয় নেতাদের ফট করে গুলি করে মেরে ফেলা যায়। শেখ মুজিবর রহমানের শিশু-পুত্রসহ পরিবারের প্রায় সবাইকে হাসতে হাসতে গুলি করে ফেলে দেয়া যায়। এ জন্য কোন বিচারের সম্মুখিন হতে হবে না, হলেও আদৌ এর কোন বিচার হয় না! স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস এদের কখনও জানতে দেয়া হয়নি।
ওই প্রজন্মই তো আজ কেউ ইউএনও হচ্ছে, সরকারি বড় কর্তা হচ্ছে। দেশের মাথায় বসে বনবন করে ছড়ি ঘোরাচ্ছে- এদের শিক্ষাটাই এসেছে এমন করে।

আমাদের দেশে ব্রেভহার্টের মতো একটা মুভি কখনই হবে না। এ দেশে সুরুজ মিয়া, ১০ বছরের বালক লালু বা অপারেশন জ্যাকপট নিয়ে কোন ডকুমেন্টারী কখখনই বানানো হবে না। আমাদের মহান নাট্যনির্মাতারা জাঁক করে বলবেন, এ দেশে ভাল স্ত্রিপ্ট কোথায়! তো, চলো ভারত থেকে আমদানী করি। খোদা না খাস্তা, কেউ বানালেও, চলবে না- ছ্যা, এইসব বস্তাপচা জিনিস আবার মানুষ দেখে!


আমি নিজেকেই দিয়েই একটা উদাহরণ দেই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কলমবাজি করার চেষ্টা করি। অথচ মতিউর রহমানকে নিয়ে মুভি বানানো হয়েছে, সিনেপ্লেক্সে চলেছে, মিলি রহমান এসেছেন। কসম, এটা আমার জানা ছিল না। শমোচৌ বলায় জানলাম (তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা)। তো, কেন যেন মনে হচ্ছে আমরা কি ভুল রাস্তায় হাঁটছি। আমরা কী অবলীলায় আমাদের মায়ের গায়ের গন্ধটা ভুলে যেতে চাইছি। কে জানে, হবে হয়তো বা!