আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সবার ভেতরের শিশুটা অবিরত কাঁদে। এই শিশুটা বড়ো লাজুক-অভিমানী, পারতপক্ষে এ জনসমক্ষে বেরুতে চায় না।
কোন এক লেখায় আমি বলেছিলাম, "আমাদের ভেতরের পশু এবং শিশু ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে- হরদম এদের মারামারি লেগেই আছে। কে যে বিজয়ী হবে এটা আগাম বলা মুশকিল। অগ্রজদের রেখে যাওয়া অর্জিত জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-নরোম মন-ধর্মীয় শেকল এই সব হচ্ছে আমাদের বাড়তি সুবিধাটুকু। এই সুবিধা নামের অস্ত্রের জোরে পশুটা ফালাফালা হয়"!
পশু এবং মানুষের মধ্যে পার্থক্য কি এটা আমার মত সাধারণকে জিজ্ঞেস করলে আমরা চট করে বলব, লেজ। কিন্তু কে কথাটা বলেছিলেন, কোথায় পড়েছিলাম মনে পড়ছে না:
"পশু এবং মানুষের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, পশু তার পূর্বপুরুষের অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগাতে পারে না কিন্তু মানুষ পারে"।
আমি কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, আমাদের অনেকের মধ্যে কিছু একটা করার গোপন স্পৃহা লুকিয়ে থাকে কেবল দিকনির্দেশনার অভাবে আমরা উৎসাহ বোধ করি না! সবার ছোট-ছোট সহায়তা আমাকে যে কী মুগ্ধ করে!
যেদিন চোখে দেখতে পান না তাঁদের সন্তানদের জন্য স্কুল [১] এবং মসজিদ করে দেয়া হলো, সেদিন সন্তানদের বাবা-মা সবাই উপস্থিত ছিলেন।
দুলাল ঘোষ নামের একজন কেবল এঁদের ছবি উঠিয়েই ক্ষান্ত হলেন না সেই ছবির বিশাল এক ব্যানার বানিয়ে দিলেন। সেই ব্যানার এখন স্কুলে ঝুলছে। ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে ঢুকেই অপার বিস্ময়ে ব্যানারটা দেখে। তাদের বাবা-মা চোখে দেখতে পান না কিন্তু এরা নিশ্চয়ই ঝলমলে মুখে বলতে থাকে, জানো বাজান, তোমার লগে আম্মা আছে, আমিও আছি; ওয়াল্লা, আমাগো কী সোন্দর যে লাগতাছে!
আমি যখন হরিজন পল্লীর স্কুলের [২] জন্য তিনটা মাদুর কিনি তখন স্কুলে নিয়ে খুলে দেখি চারটা মাদুর। আমি প্রথমে ধারণা করেছিলাম, দোকানদার ভুল করেছে। ফিরে এসে বলার পর দোকানদার উদাস হয়ে বললেন, 'থাকুক, আমার এখানে চাডিডা (মাদুর) পইরা ছিল, পোলাপান পড়ব'।
আমি যখন স্টেশনের বাচ্চাদের জন্য স্কুল [৩] করার জন্য পাগলের মত একটা ঘর খুঁজছি তখন রেলের লোকজনরা আস্ত একটা অফিস আমাদের জন্য দিয়ে দিলেন!
স্কুলের কিছু মেয়ে হাতের কাজ শেখে। এদের জন্য ফ্রেম এবং আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র কিনতে গেলে দোকানদার এর সঙ্গে আরও অনেক কিছু দিয়ে দেন, বিনে পয়সায়!
একটি দৈনিকে [৪] স্কুল নিয়ে যখন প্রতিবেদন ছাপা হয় আমার জানার আগেই রটে যায় এটা। স্টেশনের যেসব ছেলেরা পানি বিক্রি করে দিনযাপন করে, তিনবেলা ঠিকভাবে খেতেও পায় না, এরা আস্ত একটা পত্রিকা কিনে ফেলে আমাকে দেখাবে বলে। আমি জানি এদের এই পত্রিকার দাম ৮০০ পয়সা! আমার চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়।
আবার এর উল্টোটাও আছে। একজন মানুষ কিছু টাকা জমিয়েছিলেন চোখের ছানি অপারেশন করাবার জন্য। এই টাকায় অপারেশন হয় না। তাঁকে বলেছিলাম, আগে আপনাকে ডাক্তার দেখাই তারপর দেখা যাক। ডাক্তার দেখাবার পর জানা গেল এই মানুষটার অপারেশন করা যাবে না। চোখে অসম্ভব প্রেসার। তাঁকে প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ডাক্তার ওষুধ দিলেন।
যথারীতি আমাদের দেশে অতি প্রয়োজনীয় ওষুধগুলোর দাম চড়া। তো, আমি দোকানদারকে অনুরোধ করলাম, 'ভাই, মানুষটা খানিকটা সমস্যায় আছে; পারলে ওষুধের দাম একটু কম রাখবেন'।
দোকানদার নামের মানুষটা অহেতুক রূক্ষ গলায় বলেছিল, 'কিন্না যখন দিবেন পুরা টাকা দিয়াই কিন্না দেন'। আমার বুকে একটা ধাক্কার মত লাগল, একজন না পারলে না করবে কিন্তু এমন জানোয়ারের মত গাঁ গাঁ করছে কেন?
পরে এই লোকটাই বলেছিল, 'আচ্ছা, ৫ টাকা কম দেন'।
তখন আমি আর কিচ্ছু বলিনি। গুণে গুণে টাকা দিলাম, ওষুধ নিলাম। যখন চলে আসছি তখন ওই মানুষটা আমাকে বলছে, 'আরে, ৫ টাকা নিয়া যান'।
আমি শান্ত গলায় বলেছিলাম, 'এটা রেখে দেন। আপনার ইফতারের জন্য দিলাম'।
আহ, এটা বলতে পেরে কী যে শান্তি লেগেছিল! আমি এটাও মনে করি, যার যা প্রাপ্য তা তাকে বুঝিয়ে দেয়াই সমীচীন। এটা তার পাওনা, একটা পশুর প্রাপ্য।
যে মানুষটার জন্য ওষুধ কেনা হয়েছিল, মানুষটা একদিন রাস্তায় আমায় পেয়ে একটা শিশুর মত হাত-পা ছুঁড়ে হড়বড় বলতে থাকেন, 'কী তামশা, অহন সব ফকফকা দেখি'।
আমি হাসিমুখে বলি, 'আমাকে দেখতে পাইতাছেন, বলেন তো আমার হাতে এইটা কি'?
মানুষটা ঠিক-ঠিক বলে দেন আমার হাতে সেল-ফোন।
আমি লম্বা লম্বা পা ফেলে এগুতে থাকি। দূর-দূর, ওই দোকানদারের মত পশু-মানবদের নিয়ে মাথা ঘামাবার অবকাশ কই আমার...।
সহায়ক লিংক:
১. আমাদের স্কুল, দু্ই: http://tinyurl.com/2fs9j4p
২. আমাদের স্কুল, এক: http://tinyurl.com/3xpuov5
৩. আমাদের স্কুল,তিন: http://tinyurl.com/327aky3
৪. দৈনিকের প্রতিবেদন: http://tinyurl.com/3adh7uu
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Friday, September 10, 2010
কাকে কাকে যে ধন্যবাদ জানাই!
বিভাগ
আমাদের ইশকুল: দুই
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
9 comments:
ঈদ মুবারক! পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঈদ আনন্দে কাটুক। :-)
"...পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঈদ আনন্দে কাটুক।..."
@মুকুল, আমার পরিবারটা এখন একটু বড়ো হয়ে গেছে, ৭৩টা বাচ্চা! :D
ঈদ মুবারক ভাই.......
ভালো থাকবেন..........
ঈদ মোবারক শুভ ভাই .... অনেক শুভেচ্ছা রইলো
আপনাকেও ঈদ মুবারক। অনেক অনেক ভাল থাকুন।
আমার ভাষায় পানির মত টলটলে :)@mutasim
আপনাকেও ঈদের অনেক শুভেচ্ছা। আমার চোখ দিয়ে স্কুলটা দেখতে পাচ্ছেন এটাও আমার জন্য অনেক আনন্দের! @muquit
ঈদ মোবারক।৭৩ ?না।৭৪টা বাচ্চা-সবাইকে।
"...৭৩ ?না।৭৪টা বাচ্চা-সবাইকে।"
হা হা হা। ভাল বলেছেন।
আপনাকেও ঈদ মোবারক। ভাল থাকুন, অনেক।
মোসতাকিম পাগলা কেমন আছে? তাকে আমার শুভেচ্ছা দিয়েন। সে যেখানেই থাকুক, আমার শুভাশিস তাকে তাড়া করবে...। @mursalin
চমৎকার
দুলাল ঘোষকে আন্তরিক ধন্যবাদ
Post a Comment