আলীম আহমেদ কার্যত বন্দী জীবন-যাপন করছেন। কয়েদী। এই মাদক নিরাময় কেন্দ্রে এসেছেন মাত্র দশ দিন হয়েছে। অথচ মনে হচ্ছে কয় যুগ কেটে গেছে! তাঁর চার বছরের শিশুটির গায়ের গন্ধ- আহা, আসার সময় ওর একটা জামা নিয়ে এলে হতো।
তার সন্তানের শেষ ডাক কবে শুনেছেন: 'এই বাবাইন্যা-এই বাবাইন্যা। মামাইন্যা আমাকে বকা দিয়েছে'। তাঁর শরীর এখানে আটকে আছে কিন্তু মনটা পড়ে আছে বাইরে। তীব্র রোদ কখনই পছন্দ করতেন না। এখন সুতীব্র ইচ্ছা হচ্ছে, ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে হাঁটতে। মনে করার চেষ্টা করছেন শেষ কবে ইরাকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছেন। আহা, বেচারীর বেড়াবার বড় শখ। এ বছর ওঁর এক বন্ধু ফোন করার পর জানলেন ইরার আজ জন্মদিন!
আচ্ছা, দশ দিনে কয় সেকেন্ড হয়...?
এদের এখানকার নিয়ম কানুনে হাঁপিয়ে উঠেছেন। চেষ্টা করেছেন নির্দেশগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে। এখনকার চীফ তাঁর উপর পুরোপুরি সন্তষ্ট। ভদ্রলোক এক সময় আর্মির ক্যাপ্টেন ছিলেন। ড্রাগ এডিক্ট হওয়ার কারণে তার সোনালী ক্যারিয়ার হারিয়েছেন। ওদিন রসিকতা করে বলছিলেন: আমার ক্যারিয়ার এখন টিফিন ক্যারিয়ার হয়ে গেছে। আর্মিতে আপনি কেন জয়েন করলেন এটা জিজ্ঞাসা করলে হাসতে হাসতে বলেন: 'দোজ হু জয়েন দ্য আর্মি নাইন আউট অব টেন আর ফুলস, এন্ড রিমেইনিং ওয়ান ইজ ম্যাড'।
আর্মির নিয়ম কিছু কিছু এখানেও চালু রেখেছেন। প্রথম সাক্ষাতেই আলীম আহমেদ ভড়কে গিয়েছিলেন। রাশভারি গলায় এই মানুষটা বলেছিলেন: হোয়ার দ্যা হেল ডু য়্যু কাম ফ্রম?
আরেক দিন আলীম আহমেদ পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি হুংকার দিলেন: হোয়াই ডোন্ট য়্যু উইস।
এখানকার খাবার জঘন্য। খাবারের কষ্ট কেন এটা কাউকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছেন। অবশ্য তমিজ বলছিল, খাবার অপচয়ের শিক্ষাটা দেয়ার জন্য নাকি এই ব্যবস্থা। সপ্তাহে একদিন মাছ একদিন মাংস। পানির মতো পাতলা ঝোল, মাংস সাইজে একটা তেলাপোকার চেয়ে বড়ো হবে না। তিন বেলা খাবার, দু-বেলা চা-নাস্তা। প্রতিদিন নয়টা সিগারেট। কমদামী। খাবার এবং চা-নাস্তার পর পাঁচটা ক্লাসের ফাঁকে দুইটা সিগারেট খাওয়া যাবে এবং বিনোদন, টিভি দেখার সময় দুইটা। কোন একবেলা না খেলে সিগারেট ফেরত দিতে হয়। সবার সঙ্গে খেতে হবে, নিয়ম। সিগারেট শেয়ার করা বা আধ খাওয়া সিগারেট খাওয়া গুরুতর অপরাধ। যুক্তি হচ্ছে, বাইরে অন্য সময়ে কেউ সিগারেটে ড্রাগ ঢুকিয়ে দিতে পারে।
আলীম আহমেত মনে মনে হাসলেন, বিনোদনের কী বহর! টিভিতে প্রায়ই যা-তা হিন্দি ছবি দেখায়। ওদিন ধর্মেন্দ্রর একটা ছবি দেখাচ্ছিল। ধর্মেন্দ্রর নাম "হাতড়া ইন্সপেক্টর"। কী সর্বনাশ, এ ব্যাটা হাতের মুঠোয় রিভলবারে গুলি ধরে ফেলে!
আলীম আহমদ তার ডাক্তার কবীরের উপর বেশ খানিকটা ক্ষুব্ধ। তিনি আশা করেছিলেন, ডা. কবীর প্রভাব খাটিয়ে তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করবেন। কবীর টুঁ-শব্দও করেননি। আলীম আহমেদকে চারজনের সঙ্গে একটা ছোট্ট ঘরে ঘুমাতে হয়। পূর্বে তিনি কখনই কারো সঙ্গে রুম শেয়ার করেননি। এও এক যন্ত্রণা, নয়টার পর সমস্ত লাইট অফ। কী কষ্ট-কী কষ্ট! কী দীর্ঘ একেকটা রাত! এখানে আসার পর থেকেই কিছু ওষুধ দেয়া হচ্ছে। ড্রাগ বন্ধ করে দেয়ার পর শরীরে তীব্র ব্যথা হতো। পেইন কিলার টাইপের এবং সিডেটিভ জাতীয় কিছু অষুধ।
তাঁর রুম পার্টনাররা অবশ্য তাঁকে বেশ খানিকটা সমীহ করে। একদিন সাইফুল তার জামা পর্যন্ত ধুয়ে দিয়েছে। সাইফুল অসম্ভব মজার একটা ছেলে। একদিন বলছে: জানেন আলীম ভাই, আজকে দাওয়াত খেয়েছি স্বপ্নে- রোষ্ট, পোলাও, কোরমা, সালাদ, লবন, পানি কত কী।
আরেকদিন চোখ নাচিয়ে বলছে: আলীম ভাই, বলেন তো কোন জিনিস খাবার যোগাড়ের জন্য জাল বুনে, তাকে কি বলে?
আলীম বলেছিলেন: মাকড়সা।
সাইফুল হি হি করে হাসতে হাসতে বলেছিল: উঁহু, জেলে।
আরেকটা ছেলে সুকুমার। কিছু হলেই বলবে: আমি হিন্দুর পুত, আগুন হাতে লইয়া কিরা কাটলাম। কথার কথায় বলে ইয়ো বুজছনি, ইয়ো বুজছনি করে আর গন্ধকে বলে 'বুই' করে। অদ্ভুত সব কথা বলে: বাইট্টা বেডার চাইট্টা ঠ্যাং, লাফ দিয়া উডে ঘাউয়া ব্যাঙ। কিরা কাটার সময় বলবে, বিদ্যা কইলাম আমি এইটা করি নাই।
হা হা হা, একদিন কী বলছিল, গরমে মশার দাত হিড়হিড় করে। আলীম মনে করার চেষ্টা করছেন মশার কী দাঁত থাকে?
আলীম আহমেদের রুম পার্টনারদের আরেকজন তমিজ। ভারী চশমা পরা ছিপছিপে একটা ছেলে। কী মায়াকড়া চেহারা। কোন একটা স্কুলে মাষ্টারী করত। স্কুলের মজার সব গল্প বলত: ওর স্কুলে কোন এক ছাত্রী নাকি স্কুল কামাইয়ের দরখাস্ত লিখেছিল, ডায়েরিয়ার সমস্যা। ছুটির দরখাস্তের সঙ্গে চার-পাঁচটা খাবার স্যালাইনের খালি প্যাকেট সুতো দিয়ে আটকে দিয়েছিল। আরেক ছাত্রী আষাঢ়ে গল্প লিখেছিল, বৃষ্টি পড়িতেছে, ব্যাঙ ডাকিতেছে, নৌকা চলিতেছে, হুই-হুই, কী মজা!
তমিজের মাথায়ও উদ্ভট সব আইডিয়ায় ভরা। ক-দিন আগে খুব গম্ভীর হয়ে বলছে: আমার চক্ষু লজ্জা কম কারণ হলো, চোখের পাওয়ার মাইনাস ৭.৫। একদিন সিগারেটে ধরাতে গিয়ে বলছে: আলীম ভাই, আজ না আমার জন্মদিন। আগুন ধরায়া জন্মদিন পালন করতাছি।
ছেলেটা হা হা করে হাসছিল কিন্তু আলীমের চোখে জল।
আচ্ছা ভাই, 'তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে' তাহলে ডাবগাছ কি দু-পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে? ওদিন সাইফুল চকচকে একটা শার্ট গায়ে দিয়ে আগ্রহের সঙ্গে জানতে চেয়েছিল: তমিজ শার্টটা কেমন হইছে?
তমিজ নিরীহ মুখে বলেছিল: সোন্দর, তর চামড়ার সঙ্গে ম্যাচ করছে। ব্যস, মাথা ফাটাফাটি!
আলীম আহমেদের ছেলেগুলোকে বেশ লাগত। কখনো হস্টেলে থাকেননি বলেই হয়ত ওঁর কষ্টটা বেশী হচ্ছিল। মাঝে মাঝে মনে হত স্কুল জীবনের কথা। তাঁর প্রাইমারী স্কুলের সময়টা বেশ ছিল! প্রিয় বন্ধুদের একজন ছিল মুচির ছেলে, একজন ধোপার । মুচির ছেলের সঙ্গে কী মাখামাখি। ডাংগুলিতে ওর ছিল অসম্ভব পাকা হাত! এড়ি, দুড়ি, তেলকা, চুড়ি, চম্পা, ডেগ, সুতেগ। এক লাল, দুই লাল। এক লালে আস- একটা গুদাম কেনা যেত। দুই লালে নদী। এ একে একে বাজার নদী সব কিনে ফেলত। আলীম আহমেদ নিঃস্ব। ফলাফল পিঠে দুমদুম করে কিল। আরেকটা খেলা ছিল: রস, কস, শিঙা, বুলবুল, মালেক, মোসতাক। মাঞ্জা দেয়া সুতার ঘুড়ি- ঘ্যাচ, ঘ্যাচ, ঘ্যাচ। ইস, কীসব দিন!
আলীম আহমেদের শৈশব-কৈশোর এর কাছে অনেকখানি ঋণী। হারামজাদাটা পচাই খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত মরেই গেল।
মানুষ চলে যায় থেকে যায় স্মৃতি, পাখি উড়ে যায় রেখে যায় পালক। আলীম আহমেদ অপেক্ষা করছেন মুক্তির। অপেক্ষার চেয়ে কষ্টের আর কিছু নাই! ওয়েডিং ফর গডো!
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Saturday, August 14, 2010
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment