Search

Wednesday, April 14, 2010

এসো, এসো হে পান্তাখেকো

আবার বৈশাখ চলে এসেছে। পান্তাভাত খাওয়ার ধুম পড়ে যাবে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর পোয়াবারো! স্যালাইনের বিক্রির টার্গেট ছাড়িয়ে যাবে। রেকর্ড ভঙ্গ!

আহারে, একবার শিল্পীরা পান্তা খেতে গিয়ে কী নাকালই না হলেন! এরা এসেছিলেন নাচাগানা করতে। কোথায় নাচ, কোথায় গান? সবাইকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো। বিষয় কি, বিষয় আর কী! সকাল-সকাল পান্তা খেতে হবে যে। রান্না করা গরম ভাতকে তড়িঘড়ি করে ঠান্ডা করতে হবে, সময় কোথায়? বরফকল থেকে বরফের চাঁই এনে দাও ঢেলে ধোঁয়াওঠা গরম ভাতে। বরফকলের ওই বরফ ছিল আমাদের মহান ঢাকার দূষিত পানি। ফল যা হওয়ার তাই হলো।

আমি বলি কি, পান্তাভাতের সঙ্গে একটা করে ওরস্যালাইনও দেয়া হোক। সব মুশকিল আসান।  সারা বছর ফটাফট ইংরাজি বলা বাচ্চাগুলো বাংলা অক্ষর দেখে কী সোন্দর করেই না বলে, মম, এটা কি বোং-লা? এরা পান্তা খেয়ে 'বঙ্গাল' হবে! শ্লা!
আমি বুঝি না পান্তা খাওয়ার মানেটা! পিঠা-পুলি হলে নাহয় মেনে নেয় গেল। নববর্ষে নব্য বঙ্গালদের পান্তা খাওয়াটা আমার কাছে একটা চরম রসিকতা মনে হয়। আমাদের দেশের বড়ো দুখি মানুষরা, যাদের চুলা তিনবেলা জ্বলে না তাঁরা পান্তা খান। রাতের বেঁচে যাওয়া ভাত পানি দিয়ে রেখে দেন, সকালে এটাই খেয়ে কাজে বেরিয়ে পড়েন।    
 
এটা পুরনো লেখা, রিপোস্ট করছি এই কারণে একই কাহিনী নিয়ে বারবার লিখে আমার দুর্বল মস্তিষ্ক নামের হার্ডডিস্কে বাড়তি চাপ নেয়ার কোন গোপন ইচ্ছা আমার নাই। নিয়ম করে আমরা পান্তাভাত খাওয়ার একটা নাটক করব। ফি বছর একই নাটক নিয়ে লেখার কোন অর্থ হয় না। কালির অপচয় (আমি এখন কলম দিয়ে লিখি না, এই ভুল ধরার সুযোগ থেকেই যাচ্ছে)!

"ইনি এস, বি। টাকা চালাচালি যারা করেন তাদের অধিকাংশই এই ভদ্রলোককে এক ডাকে চেনেন। এস, বি সাহেবের পোশাকি নাম শাহাবুদ্দিন ভূঞা। ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু কুৎসিত রসিকতা করেছিল এস, বি নিয়ে। শালার ব্যাটা বলেছিলেন। ফাজিল বন্ধুকে শান্তি দিয়েছিলেন, কঠিন শাস্তি, তার বউকে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। বয়সটা ছিল দশচক্রে ভগবান ভূত। বয়সের সেই দবদবা এখন আর কই! শরীর অশক্ত- মন দলদলে। 
এখন মনে হচ্ছে, আহ, জীবনটা এতো ছোট, কী দ্রুতই না সময় গড়িয়ে যাচ্ছে! কী অসম্ভব ক্ষমতা তাঁর, টাকার বস্তায় শুয়ে আছেন বললে ভুল হবে চাপা পড়ে আছেন। এ দেশের আট-দশজন পরিবারের সমস্ত মাসের খরচ চলে যে টাকায় এরচে’ বেশী ফাইভ স্টার হোটেলে একজনের একবেলার খাবারের মূল্য পরিশোধ করেন। এর কোনো অর্থ হয়, শিট, বুলশিট।
 

ওঁর অফিসের রিভলবিং চেয়ারের তোয়ালের দামই ৩৮০০ টাকা, ব্যাংকক থেকে আনিয়েছেন। এ দেশে যিনি যত বড় স্যার তাঁর চেয়ারের পেছনের তোয়ালে তত দামী ! সোনার দেশের সোনার সন্তানেরা টয়লেটের জিনিস অফিসে সাজিয়ে রাখেন। কী বুদ্ধিমান সব বুদ্ধিজীবী! খোদা না করুন কোন এক দিন টয়লেটের ওই জিনিস...।

এস, বি সাহেবের কেমন চাপা কষ্ট হচ্ছে। আহা নিঃস্ব-দুঃখীদের জীবন পাল্টে দিতে পারলে বেশ হতো। এটা কি করে সম্ভব ? কখনও এসব নিয়ে ভাবেননি। আজ ভেবে কূল পাচ্ছেন না। ইয়েস, এই তো সেদিন টেলিভিশনে নাটক দেখছিলেন। কি যেন নাম নাটকটার, হিমু না ভিমু? ধনীর এক দুলাল দূর্ভাগাদের জীবন কাছ থেকে দেখার জন্যে আলগা দাড়ি লাগিয়ে সুয়েরেজ পাইপের ভেতরে গিয়ে বসে থাকে। নিশিতে দিব্যি দুই ঠ্যাং উপরে তুলে আরামে ঘুমুতে যায়। ওয়াও, কী সোন্দর-কী সোন্দর! এমন অতিমানব হতে পারলে মন্দ হতো না- এ বয়সে কি এতোটা সইবে? প্রাণটা হু হু করছে। একটা কিছু করতেই হবে।
 

তীব্র ইচ্ছা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। ১৩১০ গ্রাম ওজন বিশিষ্ট মস্তিষ্কে প্রবল চাপ পড়ছে। মনে হচ্ছে সদ্যজাত শিশুর ৩৮০  গ্রাম মস্তিষ্ক হয়ে গেছে, ব্রেন প্রায় ড্রেন। অবশেষে স্থির সিদ্ধান্তে পৌছলেন পান্তাভাত খাবেন। এই ডিশটা নাকি গরীব-টরীবরা হরদম খেয়েই যাচ্ছে। এদের খাবার খেয়ে এদের বেদনা উপলব্ধি করার চেষ্টা করবেন। তার সমস্ত পরামর্শকদের নিষেধ উপেক্ষা করলেন। জিনিসটা খাবেন, খাবেনই। ছাড়াছাড়ি নাই।

কী কুৎসিত, বাসার তিনজন বাবুর্চীর কারো এটার রন্ধন প্রণালী জানা নেই। তিনি ইংরেজীতে খুব নরম একটা গালি দিলেন, যার আদ্যাক্ষর এফ। প্রচুর টাকা কবুল করে অং বং চং চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকে শেফ ভাগিয়ে আনা হল। চীনা 

বাবুর্চীকে বললেন, তুমি কি ফাক কারিতে জানো? 
চীনা সাহেব কি বুঝলেন কে জানে, লজ্জায় লাল-নীল হয়ে গেলেন। ভুল বুঝেছেন বুঝতে পেরে স্বস্তির শ্বাস ফেলে জানালেন রেসিপি এনে দিলে জিনিসটা রান্না করতে পারবেন। অসংখ্য দুর্লভ রান্নার বই চিবিয়ে সবার গলদ্ঘর্ম অবস্থা। কোথাও এ জিনিসের বর্ণনা নেই। একজন বলল, কেকা ফেরদৌসির সঙ্গে যোগাযোগ করতে। ওনাকে পাওয়া গেল না, তিনি মহা আত্মীয়ের চ্যানেল ব্যতীত অন্য কোথাও কালো চশমা পরা মুখ দেখান না।
 

এস, বি সাহেবের এক উপদেষ্টা চট করে এ সমস্যার সমাধান করলেন। এক হাভাতেকে ধরে আনা হলো। সাহেব বাবুর্চীর ক্ষীণ সন্দেহ হলো এই চলমান এক্স-রে প্রিন্ট কি কথা বলতে পারবে ? ইতস্তত করে বললেন, ‘টুমি খি ফাক কারিতে ঝানো ফান্টাভাট ?’
হাভাতে চোখ চকচকে করে বলল, ‘জ্বে না, ফান্টা কুনু সুময় খাই নাইক্কা। নাম হুনছি, চোক্কো দেখছি, সূর্যের লাহান অয়। নাল।’
এস, বি সাহেব অনতিদূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার বমি ভাব হচ্ছে। হারামজাদার শরীর থেকে বিকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। গা কেমন গুলাচ্ছে, নি:শ্বাস বন্ধ করে রেখেছেন। নি:শ্বাস সর্তকতার সঙ্গে ছেড়ে বললেন, ‘না না, তুমি যা ভাবছো তা না। পান্তাভাত খাও তো?’
হাভাতে ভারি অবাক হল, ‘ইডা কেমুন কতা, পান্তাভাত দাদায় খাইছে বাপেও খাইছে, আমি খাই, আমগো পোলাও খায়, হের পোলাও খাইব।’
 

এস, বি বিরক্ত, আরে হা...এ দেখি অবিকল রাজনীতিবিদদের মত কথা বলছে। বাপ দেশ চালাইছে, আমিও চালাই, আমার পুলাও চালাইব। এস, বির রাগি গলা: খামোশ, ফড়ফড় করবে না। এখন বলো এটা কি করে রান্না করতে হয়?
হাভাতে: ইডা কেমতে রান্ধন লাগে আমাগো জানা নাই।
এস, বি: কামন কঙ্কাল বডি, খাচ্ছ অথচ রাঁধতে জানো না!
হাভাতে : আইজকার ভাত পানি দিয়া থুয়া দিমু, কাইল হেই পানিভাত খামু।
এস, বি: এই বিশেষ পানি কোত্থেকে আনো?
হাভাতে: কি কন বুঝি না। বালা পানি বেবার করি। আমগো ডোবাডা আছে না, দেহেন নাই? ওই যে লাইন ধইর‌্যা টাট্টি বানায়া রাখছে। হের তলে থিক্যা।
 

এস, বি সাহেব শিউরে উঠলেন। মনে হচ্ছে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন। টলে উঠতে গিয়ে সামলে নিলেন। এ সমস্যারও সমাধান হলো। পানির বদলে মিনারেল ওয়াটার ব্যবহার করা হবে। 
বুভুক্ষুটার খাওয়া আট মিলিমিটার সুপারফাস্ট ক্যামকর্ডার ভিডিও মুভি ক্যামেরায় বিভিন্ন এঙ্গেলে ছবি নেয়া হয়েছে। তিনি চাচ্ছেন অবিকল ভঙ্গিটা। পান্তাভাত কাটা চামুচ দিয়ে মুখ বন্ধ করে খেলে তো হবে না। গ্রোগ্রাসে গপাগপ করে গিলতে হবে। সিনামা পাড়া থেকে একজন দুর্দান্ত অভিনেতাকে আনা হয়েছে। ইনি এখনো ষাট বছর বয়সে চুটিয়ে কলেজ ছাত্রের অভনয় করেন। তিনমনি এই অভিনেতা একমন ওজন বিশিষ্ট পেটটা ভাসিয়ে আদুল গায়ে পা ছড়িয়ে বসেছেন। ভিডিও ক্যাসেট দেখে দেখে খাওয়ার ভঙ্গিটা রপ্ত করছেন এবং এস, বি সাহেবকে শেখাচ্ছেন।
 

ক’জন ডাক্তার নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন। এদের প্রত্যেকেরই আছে নিজ পেশায় অভাবনীয় সুনাম এবং নামের পেছনে এ.বি.সি.ডি ওয়াই, জেড কাড়ি কাড়ি বিজাতীয় অক্ষর। দুটা এম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়েছে, একটা বিকল হলে অন্যটা কাজে লাগানো হবে। হাতের নাগালে ওরাল স্যালাইন, আই ভি ফ্লুইড রাখা হয়েছে। ফুড পয়জনিং হলে অন্য ব্যবস্থা।
দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, অতি প্রত্যুষে এস, বি সাহেব পান্তাভাত খাবেন। নতুন একটা সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হবে অন্য রকম একটা দিন। রাতেই তিনি মা’র পা ছুঁয়ে সালাম করলেন: মা, দোয়া করো আমার জন্যে। আমি পান্তাভাত খেতে যাচ্ছি।
এস, বি সাহেবের মা কী অবাকই না হলেন! আহা, কতো দিন, কতো দিন পর তার সন্তান গাঢ় স্বরে তাঁর কাছে আসল, তাঁকে ডাকল, আহা, কী গভীর মমতায় তাকে ছুঁয়েছে: খোকা-খোকা, অ খোকা, পা-পান্তা ভা-ত কি বলছিস ছাইপাশ, এটা খাবি কেন, কি কষ্ট তোর!
ও তুমি বুঝবে না, মা। সমস্তটা জীবন হেলাফেলা করে কাটিয়েছি। এবার মানব সেবা করতে চাই।
মার বিস্ময়ের শেষ নেই, এটা খেলে মানব সেবা হবে? খেতেই যদি হয় তোর বদলে অন্য কেউ খাবে, তুই কেন? তোর সব কাজই তো অন্যরা করে। এটাই নিয়ম।
 

এস, বি সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অজান্তেই মা বড়ো ভুল বলেননি। তার বাবা হওয়ার ক্ষমতা নেই অথচ ছেলেটা আরিজোনায় পড়াশুনা করছে।
মনখারাপ করা শ্বাস ফেলে বললেন, তা হয় না মা। এ মহান কাজটা আমায় করতেই হবে। সকাল সকাল তোমার ঘুম ভাঙ্গাতে চাই না বলেই এখন আসলাম। এইবার বিদায় দাও।
এস, বি সাহেব বেরিয়ে যেতে যেতে ভাঙ্গা অস্ফুট গলায় গাইলেন: একবার বিদায় দে মা পান্তা ভাত খেয়ে আসি। আঁ আঁ আঁ আঁ।

তিনি ভোরের অপেক্ষা করছেন। কী অসহ্য অপার্থিব একটা ভোরের প্রতীক্ষা। কিন্তু ভোর তো আর হয় না, মনে হচ্ছে প্রিয় মানুষের লাশ সামনে নিয়ে বসে আছেন। ভোর হয়, ভোরকে কেউ আটকাতে পারে না। কেউ কেউ ভোরের প্রতীক্ষা করে করে শেষ প্রহরে হাল ছেড়ে দেয়, এ ভুবন থেকে অন্যভুবনে যাত্রা করে। তিনি হাল ছাড়বেন না। পান্তা খাবেন, খাবেনই- ছাড়াছাড়ি নাই।"

3 comments:

Unknown said...

গবীল আগ্রহ নিয় লেখাটা পড়া শুরেু করেছিলাম। ভালো ো চিন্তার খোরাক দুেটাই অনুভব করছিলাম। লেখাটাা বোধহয় বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে। কাজে ব্যবস্ত পড়ে পড়ব। দু:খিত।

admin said...

পান্তা খাইছি আইজ। তবে ফ্রি। জেলা প্রশাসনের অনুষ্ঠানে আয়োজন ছিলো। এক বড় আপা ধৈরা নিয়া গেলো। ক্ষুধাও লাগছিলো। খাইতেও ভালৈ লাগছে। স্বাস্থ্যসম্মত পান্তা। :D

আলী মাহমেদ - ali mahmed said...

হ্যাঁ, লেখাটা খানিকটা বড়ো হয়ে গেছে, উপায় ছিল না@Kazi

@মুকুল পান্তা খাওয়া নিয়ে লেখাটার মূল সুর ছিল না। আসলে ভড়ংটা দেখতে ভালো লাগে না।
এটা আমাদের রক্তে খেলা করে, সমস্তটা জীবন এলোমেলো চলব, বুড়া হয়ে গেলে দাঁড়ি-টাড়ি ছেড়ে ফেরেশতা হয়ে যাব!
সারা বছর বাংলা ভাষার বারোটা বাজিয়ে বছরের একদিন 'বঙ্গালবাবু' সাজার কোন অর্থ হয় না!

আমি এও মনে করি, বছরের একদিন অন্তত আমাদের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে, মন্দ কী?