Friday, December 23, 2011

তিতাস একটি ...এর নাম

শিরোনামটা আমি দিতে চেয়েছিলাম, 'তিতাস এক ধর্ষিতার নাম'। রগরগে একটা শব্দ বেছে নিয়েছি বলে কেউ কেউ কটাক্ষ করবেন কেবল এই কারণে শিরোনামটা দিলাম না, এমনটা না। কারও ভাবাভাবিতে আমার বয়েই গেছে!
কিছু কিছু শব্দ আমি এড়িয়ে চলি যেমন ধর্ষণ, ধর্ষিতা। বহুলব্যবহৃত এই শব্দটা ব্যবহারে আমার বিশেষ উৎসাহ নাই। কারণ আমি বিলক্ষণ জানি, অন্য রকম করে লিখলেও একজন প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকের এটা বুঝতে বাকী থাকে না। তাছাড়া আমি সৈয়দ হক,
মিলন, তসলিমা নাসরিনের মত উঁচুমার্গের লেখক না যে পারলে কাগজে-কলমে ছবি একেঁ বুঝিয়ে দেব এটা কাহাকে বলে কতো প্রকার ও কি কি?

'খোদেজা' নামের একটা কিতাব আছে আমার। খোদেজা নামের একটি শিশুকে নিয়ে লেখা। যে মেয়েটিকে করা হয়েছিল চরম শারীরিক নির্যাতন। ওখানেও আমি ধর্ষণ, ধর্ষিতা লিখতে পারিনি, যথাসম্ভব এড়িয়ে গেছি। অল্প কথায় সারার চেষ্টা করেছিলাম:
"...সাত বছরের এই শিশুটির প্রতি করা হয়েছিল ওর জানামতে চরম শারীরিক অন্যায়। অভাগীর জান্তব চিৎকার থামাবার জন্য মুখে গুঁজে দেয়া হয়েছিল মুঠো মুঠো বালু। নর নামের ওই নরপশুরা খোদেজার জানাজায়ও অংশ নিয়েছিল।...।" []

যাই হোক, সূত্রপাত এভাবে। আমাকে একজন মেইল করে তিতাস নদীর উপর একটি প্রতিবেদন, ইউটিউবের একটা লিংক পাঠিয়েছেন:
এটা দেখে আমি হতবাক! লম্বা একটা সময় এলাকায় ছিলাম না। আমার অসম্ভব একজন প্রিয়মানুষকে নিয়ে [২] আমি দৌড়ের উপর ছিলাম। এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আমার জাগতিক নানাবিধ সমস্যা। তেমন একটা বের হওয়াও হয়নি। আজ এখানে এসে দেখি এই অবস্থা!

থাকুক এসব। আমার কাছের লোকজনেরা জানেন তিতাস নদী নিয়ে আমার অন্য রকম আবেগ আছে। এক লেখায় আমি লিখেছিলাম:
"...কে জানে, প্রবাসে কোথাও আটকা পড়ব, শ্বাস আটকে থাকবে জন্মভূমির জন্য। কী কষ্ট-কী কষ্ট! তখন তিতাসের বাতাসভর্তি ক্যানটা থাকলে, ব্যস। কেউ একজন ছিপিটা খুলে আমার নাকের কাছে ধরবে। আহ, তিতাস নদীর বাতাস, কী নির্মল! দুচোখে নেমে আসবে না-ভাঙ্গা ঘুম। পারিজাত প্রশান্তি নিয়ে অন্য ভুবনে যাত্রা। আহ, ঘু-ম-ম!...।" [৩]


হা ঈশ্বর! এরা এই তিতাসের এ কী অবস্থা করেছে? লেখার শুরুতে যেটা বলেছিলাম, এখন ওই শিরোনামটাই বুকের ভেতর থেকে পাক খেয়ে উঠছে, 'তিতাস এক ধর্ষিতার নাম'! 'তিতাস একটি নদীর নাম'- কে বলে? এখন তিতাস একটি খালের নাম!
কেবল এখানটায় যে নদীকে দু-ভাগ করে ফেলা হয়েছে এমন না। আশুগঞ্জ থেকে শুরু করে আখাউড়া পর্যন্ত যতগুলো ব্রিজ কালভার্ট আছে; সংখ্যাটা বলা হচ্ছে, সাতাশ। আমার ধারণা, সংখ্যাটা এরচেয়ে বেশী হবে। অর্থাৎ সবগুলো জায়গায় এখানকার মত নদীর উপর রাস্তা করা হয়েছে। চালু কথায় বাঁধ দেয়া হয়েছে।

একটা নদীর যত্রতত্র বাঁধ দিলে এটাকে নদী না-বলে বড়ো-বড়ো পুকুর বা খাল বলাই শ্রেয়। এটা বলার জন্য রকেটবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
নদীর কী গতি হবে এটা নদী বিশেষজ্ঞরা ভাল বলতে পারবেন। মানুষদের কথা নাহয় বাদই দিলাম। বেচারা মাছগুলোর জন্য খানিকটা সমস্যা হয়ে গেল। এদিককার মাছ ওদিকে যেতে পারবে না। না পারবে। এর জন্য তাকে ট্রানজিট ব্যবহার করতে হবে। কষ্ট করে নদীর মাঝের এই রাস্তাটা পেরুতে হবে।
নিজের জন্যই এখন আর এলিজি লেখার অবকাশ নাই আবার মাছের জন্য এলিজি...[৪]! হুশ!

শস্তা আবেগ থাকুক, এবার কাজের কথা। আমাদের সরকার ট্রানজিটের নামে এমনটা কেন করলেন? যতটুকু জানি, এই জন্য আমাদের সরকার বাহাদুর টাকা-পয়সা যা পেয়েছেন তা বাদামের খোসা। এর জন্য যে ব্রীজ-কালভার্টগুলো আছে তা যথেষ্ঠ বলা চলে তবে ট্রানজিটের জন্য যে গাড়িগুলো চলবে তার জন্য রাস্তা চওড়া করা হয়েছে এবং এর জন্য আমরা ভারত থেকে কিছু সুবিধা পেয়েছি।
তাহলে কর্তৃপক্ষ এই কান্ডটা, এই নদীতে বাঁধ দিয়ে আরেকটা রাস্তা কেন করতে গেলেন? এটা করা হয়েছে ১২০ চাকার ট্রেইলরগুলো চালাবার জন্য। কেন এই ট্রেইলরগুলো এখান দিয়ে চালাতে হবে? কারণ এই ট্রেইলরে করে যে মালসামান যাবে তা এই চালু রাস্তায় নেয়া সম্ভব না। এই মালসামানের কাহিনী কি? কাহিনী আর কিছুই না, আগরতলায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে, ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রপাতির জন্য। ভাল কথা! আমাদের কি দায় পড়েছে আগরতলার বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য?

আমাদেরকে বলা হয়েছিল, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৭২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে। এখান থেকে আমরা ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাব। চরম বিদ্যুৎসংকটে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া চাট্টিখানি কথা না। আমরা বিগলিত হয়েছি, মোমের মত গলে গেছি। হয়তো এই কারণে কর্তৃপক্ষ এই কান্ডটা করে থাকতে পারেন।

তর্কের খাতিরে আমি তিতাস, তিতাসের বাতাস বা মাছদের পক্ষ না-নিয়ে যদি সরকারের পক্ষ নেই তাহলে যা দাঁড়ায়:
আগরতলায় বিদ্যুত কেন্দ্র বসাবার নাম করে যেসমস্ত ভারী যন্ত্রপাতি নেয়ার জন্য এই দক্ষযক্ষ শুরু হয়েছিল ওই বিদ্যুত প্রতিষ্ঠানের নাম পালাটানা। যেটা পূর্বেই বলেছি, বাংলাদেশ হয়ে পালাটানা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালসামান এখান দিয়ে পরিবহণ হওয়ায় বাংলাদেশ ত্রিপুরা থেকে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আশা করেছিল। এই নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়েও আলোচনা হয়েছিল। ত্রিপুরার মূখ্যমন্ত্রীরও এতে আপত্তি নেই বলেও জানিয়েছিলেন। আগরতলার পত্রিকার খবরে বলা হয়, আগামী ১৫ মে থেকে বানিজ্যিক উৎপাদনে যাবে। এবং ওই কেন্দ্র থেকে ৭২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে।

পত্রিকাটি থেকে আরও জানা যায়, আসাম রাজ্য ২৪০ মেগাওয়াট, ত্রিপুরা ১৯৬, মনিপুর ৪২, মেঘালয় ৭৯, নাগাল্যান্ড ২৭, মিজোরাম ২২, অরুণাচল প্রদেশ ২২ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ পাবে। বাকি ৯৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আইএল এন্ড এবং এনটিপিসি'র শেয়ার হিসাবে থাকবে। [৫] (ডেইলি দেশের কথা, ২১ ডিসেম্বর, ২০১১) 

গণকযন্ত্র নিয়ে আরাম করে লেপের নীচে বসে আঁক করে দেখা যাবে কাঁটায় কাঁটায় মিলে গেছে ৭২৬ মেগাওয়াট! তাহলে বাংলাদেশ পাচ্ছেটা কি? লাড্ডু? 'দিল্লী কা লাড্ডু'- লাড্ডুর জন্য দিল্লীর বড়ো সুনাম। লাড্ডুর জন্য যাদের কাতরতা তারা কষ্ট করে 'হাওয়াই জাহাজে' করে দিল্লি গেলে আটকাচ্ছে কে? আমার কেবল একটাই পরামর্শ হাওয়াই জাহাজের জানালার বাইরে মুখ বের না-করার জন্য। কেবল এই জন্য না যে জানালায় এইসব মাথামোটাদের মাথা আটকে যাবে। চোখ মতান্তরে চশমা ঝাপসা হবে:
"ভুলেও হাওয়াই জাহাজের জানালায় মুখ বাড়িয়ো নাকো, মা-
পেঁজা পেঁজা মেঘে ঝাপসা হবে তোমার চোখের চশমা।" 
...
বানরের পিঠা ভাগাভাগি:
উৎস: ডেইলি দেশের কথা, ২১ ডিসেম্বর, ২০১১
 * তিতাসের কিছু ছবি: http://www.facebook.com/media/set/?set=a.10150461668962335.368455.723002334&type=1&l=7dc27b5cfc
** কিছু তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বিশ্বজিৎ পাল বাবু। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। 

সহায়ক সূত্র:
১. খোদেজা: http://tinyurl.com/33xcevn
২. হাসপাতাল পর্ব: http://tinyurl.com/boya6xk
৩. তিতাসের বাতাস...: http://www.ali-mahmed.com/2009/06/blog-post.html
৪. মাছের জন্য এলিজি: http://www.ali-mahmed.com/2009/06/blog-post_6002.html
৫. ডেইলি দেশের কথা, ত্রিপুরা: http://www.dailydesherkatha.com/content.php?issue=2011-12-21&page=main  

7 comments:

  1. শুভ ভাই,গালী দিতে ইচ্ছা করছে। আপনার এখানে গালী দেয়া যাবে না?

    ReplyDelete
  2. শিরোনামহীন,আপনার এই পোস্ট কি তিতাস নদি নিয়ে ছিল?http://www.ali-mahmed.com/2011/09/blog-post_16.html

    ReplyDelete
  3. সুমন রহমানDecember 24, 2011 at 9:35 AM

    আলী মাহমেদ, আগরতলার পত্রিকার রেফারেন্সটা কি একটু দিতে পারেন, যেখানে পালাটানায় উৎপাদিত বিদ্যুতের বণ্টন সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে?

    ReplyDelete
  4. হুঁ, ওটা তিতাস নদী নিয়েই লেখা @রোহান

    ReplyDelete
  5. দুঃখ প্রকাশ করি, এমন জরুরি একটা তথ্যের লিংক না-দেয়া অনুচিত হয়েছে!
    তথ্যটা পাবেন এখানে:
    http://www.dailydesherkatha.com/content.php?issue=2011-12-21&page=main

    যাই হোক, এখন মূল পোস্টের সঙ্গেও জুড়ে দিয়েছি। মন্তব্য আকারে এখানেও দিলাম। ত্রিপুরার 'দেশের কথা' পত্রিকার সাইটটায় কখনো কখনো পড়তে ঝামেলা হয় বিধায় একটা ক্রিণশটও মূল পোস্টের সঙ্গে যুক্ত করে দিলাম। @সুমন রহমান

    ReplyDelete
  6. thanks Ali vai for writing on this topic

    ReplyDelete

আপনার যে কোন মত জানাতে পারেন নিঃসঙ্কোচে, আপনি প্রাসঙ্গিক মনে করলে।