আজ থেকে অতিথিদের লেখা যুক্ত হচ্ছে। কারও লেখা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলে লেখকের অনুমতিক্রমে এখানে প্রকাশিত হবে। আজকের পর্বটি লিখেছেন: Gulzar Hossain Ujjal, লেখার শিরোনাম কেবল বদলে দিলাম।
![]() |
| “মুক্তির গান” ছবিতে মাহমুদুর রহমান বেণু |
তবে তাঁর গান মনোযোগ দিয়ে প্রথম শুনি খুরশীদ স্যারের বাসায়। (খুরশীদ স্যার, মানুষটার কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। আমারে তুমি অশেষ করেছ….)।
দুই হাজার চার সালের দিকে হবে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে মাহমুদুর রহমান বেনুর একটা অ্যালবাম বেরিয়েছিল। খুরশীদ স্যার চেয়েছিলেন আমি যেন বেনুর গাওয়া নজরুল সঙ্গীত 'প্রভাত বীনা তব বাজে' গানটি শিখি।
ক্যাসেট প্লেয়ার বাজছে, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি। ভোকাল থ্রোয়িংটা অসাধারণ! গলায় কি জোর ! একদম যাকে বলে টেনর (TENOR) ভয়েস। পৌরুষদীপ্ত কন্ঠ, কোন কৃত্রিমতা নেই। জোর করে গলাটা মিষ্টি করার চেষ্টা নেই।
স্যার চান আমি যেন সুরটা কপি করি, সাথে তাঁর গাওয়ার ভঙ্গিটাও যেন আয়ত্ব করি। এ এক সমস্যা! আমাকে যে স্যার কী মনে করেন! কার সাথে কি? এরকম ভরাট গলা আমি কোথায় পাব! আর গানটায় যে অজস্র সুরের খেলা! তাও আবার ভৈরবী রাগের ওপর। রাগ-রাগিনীতে আমার দখল নেই বললেই চলে। আমি হলাম শ্রুতিধর। শুনে শুনে গাই, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত হোক আর ব্যান্ড সঙ্গীতই হোক। গানের তত্ত্বজ্ঞানও তথৈবচ। আমি বললাম ক্যাসেটটা দেন। আর দু সপ্তা সময় দেন, দেখি তুলতে পারি কিনা?
স্যার বললেন, "বেনু ভাইয়ের আরেকটা পরিচয় আছে। 'বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা' বলে যে দলটা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে ক্যাম্পে গান শুনিয়েছিল, যাদের ভিডিও ফুটেজ নিয়ে পরবর্তী কালে ‘মুক্তির গান’ বলে একটা ছবি হলো, বেনু ভাই ছিল তার দলনেতা"।
আমি অবাক হলাম। জানতাম না তো! ‘মুক্তির গান’ ছবিটা তো দেখেছি। লিয়ার লেভিনের ভিডিও ফুটেজ অবলম্বনে তৈরী তারেক মাসুদের ছবি। ছবিটার প্রসংগ এলেই সবাই খালি তারেক মাসুদের নাম করে। কিন্তু এই মাহমুদুর রহমান বেনু’র নামটাতো কেউ একবারও নেয় না। কী অদ্ভুত! কী অন্যায়! অথচ তিনিই এই দলটার দলনেতা। আরেকটা মানুষ এ দলটার পেছনে ছিলেন ছায়া হয়ে। নেপথ্যে নেতৃত্ব দিয়েছেন, উৎসাহ যুগিয়েছেন। তিনি হলেন সঙ্গীত গুরু ওয়াহিদুল হক।
বেনু তাঁর প্রিয় ছাত্রদের একজন। দলটির প্রায় সবাই ছিল তার প্রত্যক্ষ ছাত্র। তার ভাবনা, পরিকল্পনা আর উৎসাহের ফসল এই গানের দলটি। অথচ চিরটা কাল এক্ষেত্রে তিনিও অপাংক্তেয়, অনুচ্চারিত।
যাই হোক ক্যাসেটটা বাসায় নিয়ে এলাম। শুনতে লাগলাম মাহমুদুর রহমান বেনু। সত্যিই এক অদ্ভুত কন্ঠ। গানটা যখন বাজে পুরো ঘরটা তখন সুরে ভরে যায়। ভৈরবীর সুরে ভোর নেমে আসে । 'ভোরের হাওয়ায় ঘুম ভাঙ্গাতে এলে চুম হেনে নয়ন পাতে….'।
এই বিরল কন্ঠের মানুষটা এখন লন্ডন থাকেন। হয়তো অভিমান। এদেশে তার গানের যোগ্য কদর হয়েছে কি? কিছুদিন আগে শাহবাগের সুর কল্লোলে (আমার সেই সিডির দোকান, যেখান থেকে নিয়মিত সিডি কিনি) গিয়ে সিডি দেখছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়লো বেনু ভাইয়ের নতুন একটা গানের সিডি।
এটা কবে বেরুলো? দোকানের বয়স্ক মালিক (তিনি একজন বিশিষ্ট সুর রসিক, অনেক বড় বড় শিল্পীর সাথে তার জানাশোনা) জানালেন, “গত বছর বেনু ভাই নিজে হাতে তিনটি কপি দিয়ে গেছেন। দুটো বিক্রি হয়ে গেছে, এই একটাই আছে। ভাল কথা, আপনি তার গান শোনেন?” ভদ্রলোক আমার দিকে একটু অন্যরকম চোখে তাকালেন।
আমি বললাম, “শুনি তো বটেই, মাঝে সাঝে গিলিও”। মানুষটার চোখে আনন্দ খেলা করে। কেন করে সেটা আমি বুঝি। ভদ্রলোক বলেই চলেছেন, “জানেন তো উনি লন্ডনে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের পর দুবছর বাংলাদেশে ছিলেন । তারপর থেকেই বাইরে। লন্ডনে পিএইচডি করতে গিয়েছিলেন ।
গানের নেশায় আর পিএইচ ডি করা হয়নি। সেই রাগে বউ তাকে ছেড়ে চলে এসেছেন বাংলাদেশে। আর উনি এখন ওদেশে বাংলা স্কুলের টিচার। গানও শেখান। লন্ডনের সব কালচারাল অনুষ্ঠানেই তিনি পুরোধা। জানেন, এই অ্যালবামটা কোনও প্রযোজনা সংস্থা বের করেনি। উনি নিজের উদ্যোগে নিজ খরচায় রেকর্ড করিয়ে নিজেই বিলি করছেন।"
আমি অবাক হই না। এই দেশে শুদ্ধ শিল্পী, শুদ্ধ মানুষ কারুরই খুব একটা কদর হয় না। এরা এই সমাজের ব্যর্থ, অচল মানুষ। প্রবাস জীবন নিয়ে যতই নেতিবাচক কথা বলি না কেন এ কথা কিন্তু সত্যি, বিদেশ এদের অঞ্জলী পেতে গ্রহন করে। বিদেশ এদের সম্মান, প্রতিষ্ঠা সব দেয়।
একজন মাহমুদুর রহমান বেনু, যিনি ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা'’র অন্যতম সংগঠক ও দলনেতা, মুক্তিযুদ্ধের মহান কন্ঠসৈনিক, সর্বোপরি একজন শুদ্ধ সঙ্গীতের সাধক শিল্পী- এ প্রজন্মের ক’জন তাকে চেনে? রাষ্ট্র তাকে কি সম্মান দিয়েছে শিল্পী হিসেবে কিংবা মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য। আমাদের সংবাদপত্রগুলো ডিসেম্বর আর মার্চ এলে নানান রকম আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। সেই আয়োজনেও চোখে পড়েনা একজন মহান বেণুকে নিয়ে।
অবাক লাগে ইত্তেফাকের মত একটি পত্রিকায় 'বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা' ও ‘মুক্তির গান’ নিয়ে ফিচার বের হয় কিন্তু সেখানে তাঁর নাম থাকেনা। এরকম উদাহরণ আরো আছে। তার সাক্ষাৎকার কি কোন কালে কারো চোখে পড়েছে কোন পত্রিকায়? আমার পড়েনি। আমাদের বিনোদন ও সাংস্কৃতিক সাংবাদিকরা এদের সাক্ষাৎকার নিতে বেশী আগ্রহী না।
মারুফ নামের এক নায়ক কেন গোঁফ রাখলেন, শাকিব খান নায়িকা অপু বিশ্বাসকে বাড়িতে গিয়ে কেন মারধোর করলেন এই হলো আমাদের বিনোদন পাতার হট টপিক। আমি আশংকা করি কোন একদিন হয়তো শিল্পী বিপুল ভট্টাচার্য’র মত তিনিও দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হবেন। তারপর তাঁকে নিয়ে একটা খুব করুণ ফিচার হবে। সাংবাদিক তাঁর সমস্ত প্রতিভা ঢেলে দেবেন এদেশের মানুষ কতটা অকৃতজ্ঞ তা প্রমান করতে।
শর্ষীনার পীরের মত যুদ্ধাপরাধীরা এদেশে ‘স্বাধীনতা পদক’ পায় সুতরাং এসব রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার নিয়েও কিছু বলার প্রয়োজন দেখিনা। এ প্রজন্মের কেউ একজন বেনুকে না চিনলে তাঁর কিছু আসে যায়না, দেশ তাকে সম্মানিত না করলেও কিসসু আসে যায়না তাঁর। বরং ক্ষতি হয় দেশটার, ক্ষতি হয় দেশের আত্মপরিচয়হীন উত্তর প্রজন্মের।
যাই হোক, আমি মাহমুদুর রহমানের বেনুর এ বছরের তৃতীয় ক্রেতা হিসেবে সিডিটা কিনে নিয়ে যাই। আজ কদিন ধরে গানগুলো শুনি। আমার আশেপাশে যারা থাকেন তাদেরও শোনাই। আমি শুনি আর ভাবি, উনি লন্ডনে গিয়ে বেঁচে গেছেন। এদেশে থাকলে তাঁর হয়তো এই সিডিটাও বের করা হতো না...!

দারুন একটা কাজ হয়েছে,লেখককে ধন্যবাদ।
ReplyDeleteসৌভাগ্যক্রমে এই পোস্টের লেখকের সৌজন্যে মাহমুদুর রহমান বেণুর গান শোনার সুযোগ হয়েছে। এই বিষয়ে মন্তব্য করব না কারণ খুব ভাল জানি এমন কোন বিষয় এই গ্রহে নাই, গানও! তবে গানের বিষয়ে আমি সর্বভূক- ভাল লাগলেই হলো।
ReplyDeleteবাংলায় খেয়াল নিয়ে খেলা আজাদ রহমান ব্যতীত অন্য কেউ করতে পারেন এমনটা জানতাম না। জানলাম মাহমুদুর রহমান বেণুর গান শুনে। কখনও বিভ্রান্ত হয়েছি, আমি কী আজাদ রহমানকে শুনছি!...
Salute
ReplyDeleteচ্রমস :)
ReplyDeleteআমাগো দেশের মিডিয়া হালাগো গদাম
ReplyDeleteচমৎকার একটা ঘটনা নিয়ে লেখার জন্য লেখক গুলজার সাহেবকে ধন্যবাদ। >Anonymous< আপনার সাথে সহমত জানালাম,মিডিয়াকে গদাম ইত্তেফাকের পেছনে লাত্থি
ReplyDeleteআমি সিডি কিনে মুক্তির গান আবার দেখি। ছবিটির ধারা বর্ণনাকারী, এই দলের ই একজন তারেক আলী বলছেন “আমাদের এই দলটির দলনেতা মাহমুদুর রহমান বেণু……”। একটি দৃশ্যে আমার চোখ আটকে যায়। ভ্রাম্যমান এই দলটিকে বহন কারী ট্রাকটি বিকল হলে দাড়ায় একটা পুকুরের পাশে। ট্রাক মেরামত চলছে। অদূরে দাড়িয়ে কেউ পেপার পড়ছে, কেউ গল্প করছে। বেণু পুকুর ধারে বসে রেওয়াজ করছে রামকেলী রাগে, হারমোনিয়ামে সংগত করছে বিপুল ভট্টাচার্য। এই হলো বেণু, গান তার রক্তে, সমস্ত সত্তায়।
ReplyDeleteআলী ভাই গান গুলি ঠিক খেয়াল নয়।রাগপ্রধান নজরুল সঙ্গীত। তাই খেয়ালের মত লাগছে। সাথে কিছু পুরাতনী বাংলাগান আছে ,এগুলো টপ্পা অংগের গান। আর আজাদ রহমান তাঁর সঙ্গীত গুরু। সম্ভবত একারণে গায়কীতে একটা প্রভাব পড়েছে।
ReplyDeleteউনার গানের একটা লিংক পেয়েছি। ইউটিউবে আছে.....http://www.youtube.com/watch?v=p98xfKOjE1I
ReplyDeleteআগ্রহীরা শুনতে পারেন।
সত্যিই অসাধারণ একটা কাজ হয়েছে। এই পোস্টের লেখককে আমার পক্ষ থেকেও ধন্যবাদ @শাহেদ
ReplyDeleteধন্যবাদ @Nuhan
ReplyDelete:) @azgor
ReplyDeleteগদাম শব্দটা অনেক দিন পর শুনলাম @Anonymous
ReplyDeleteআপনাকেও ধন্যবাদ@রায়হান
ReplyDelete"আলী ভাই, গান গুলি ঠিক খেয়াল নয়।...।"
ReplyDeleteপ্রথমেই আমি দুঃখ প্রকাশ করি। অবশ্য মন্তব্যে আমি বলেছিলাম, ...খুব ভাল জানি এমন কোন বিষয় এই গ্রহে নাই, গানও!
আমার কাছের লোকজনরা জানেন, সব বিষয়েই আমার জ্ঞান ভাসা-ভাসা! অতশত কী আর আমি বুঝি, তাঁর গানের কিছু অংশ শোনার সময় আমার মনে হচ্ছিল, আরে, এ তো স্রেফ খেয়াল...:) @Omio Ujjal
ধন্যবাদ, আপনার লিংকের জন্য @গুলজার
ReplyDelete