Saturday, July 24, 2010

ঈশ্বরের বিশেষ সন্তানদের ইশকুলের প্রথম দিন

ছোট-ছোট স্বপ্নের [১] একটা অংশ এই ইশকুল। ইশকুলের সময় ৫টা থেকে ৬টা। ইচ্ছা করেই সময়টা কম রাখা হয়েছে কারণ দীর্ঘ সময়ে বাচ্চারা বিরক্ত হবে। একবার পড়ায় এদের অনীহা এলে ধরে রাখা মুশকিল।

ইশকুলের আজ (২৩ জুলাই, ২০১০) প্রথম দিন। আজ আমার যাওয়ার কথা না। কী করব, আমার চেয়ে লোকজনের উৎসাহ প্রবল, বাইক-বয় ২০ কিলোমিটার পথ মাড়িয়ে এসে হাজির। যেতে হয়, ভালই হলো।
আমার ধারণা ছিল, এলোমেলো একটা অবস্থা থাকবে। তেমন কাউকেই পাওয়া যাবে না। ধারণা করি, কাঁটায়-কাঁটায় পাঁচটায় ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে। আমরা গেছি ১০ মিনিট পর। ছাত্র আরও ৩জন বেড়েছে। সব মিলিয়ে হলো ২৩ জন। আজ পেয়েছি ২০ জনকে।

হরিজন পল্লীতে যেটা করতাম, বসি বাচ্চাদের সঙ্গে মাদুরে। টিচার নামের পিচ্চি মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়েছিল।

তাকে নিষেধ করলাম। এই মেয়ে, তোমাকে কাল কি বলেছিলাম, বাচ্চাদের কাছে আমি যেটা চাইছি, এরা ভাবতে শিখুক এখানে টিচারের উপর কেউ নেই। টিচারের সংকোচ কাটাতে বেগ পেতে হয়।  
আক্ষরিক অর্থেই আমি অভিভূত! আজ গিয়ে দেখি, গতকাল বলে আসা অনেক কাজ এরা করে ফেলেছে। বাচ্চাদের হাতের নোখ ছোট, দাঁত পরিষ্কার। 
টিচারকে জিজ্ঞেস করছিলাম, বাচ্চাদের জন্য আর কি যোগ করা যায়? বাচ্চারা আমাকে শেখায়, বাথরুম থেকে বের হয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হয়।
আমি বলি, সাবান না পাইলে কি করবা?
বাচ্চারা চিন্তায় পড়ে যায়।
আমি বলি, সাবান না পাইলে ছাই। আবারও বলি, ছাই না পাইলে?
বাচ্চারা আবারও চিন্তিত। আমি বলি, ছাই না পাইলে মাটি।

সাথে নেয়া চকলেট সবগুলো রেখে এদের বলি, প্রত্যেকে একটা কইরা নিবা। যে দুইটা নিবা সে চোর। 
বাড়তি একটা চকলেট টিচারের জন্য থাকার কথা। আমাকে অবাক করে দিয়ে টিচারের জন্য একটা চকলেট থেকে যায়। হরিজন পল্লীর সঙ্গে এদের ফারাকটা আকাশ-পাতাল। ওখানকার বাচ্চাদের এটাই শেখাতে আমার প্রায় দু-মাস লেগেছে!

রাজা-রানি-রাজকুমার-দুষ্ট-স্কুলের ফাঁকিবাজি-টিচার, বাবা, মার কথা না শোনা-মিথ্যাবাদি-চোর-আল্লাহর শাস্তি-কাক এই রূপকথাটা [২] বলার পর গল্পটা এরা ভালই মনে রাখতে পেরেছে। গল্পের মূল বিষয়টাও চট করে ধরতে পেরেছে। এখন আমার স্থির বিশ্বাস এই বাচ্চারা অনেক অনেক ভালো করবে। 
এবং এটাও আমি মনে করি, হরিজন পল্লীর জন্য যে টিচার রাখা হয়েছে ওই টিচার থেকে ক্লাশ এইট পড়ুয়া এই পিচ্চি মেয়েটা অনেক ভালো করবে। অথচ ওই টিচার প্রফেশনাল, বাচ্চা পড়ানোই ওনার কাজ, সমস্তটা দিন এটাই তিনি করেন। তারপরও আমি ঠিক কি চাচ্ছি এটা সম্ভবত তিনি এখনো ধরতে পারেননি। অথচ এই মেয়েটা চট করে ধরে ফেলেছে। যার নমুনা আমি আজ দেখলাম।

গতকাল এদের যে ছবিগুলো উঠিয়েছিলাম আজ ল্যাপটপে ওই ছবিগুলো দেখিয়ে বলি, তোমরা এখানে কারা কারা আছো খুঁজে দেখো তো। একেকজন নিজেদের খুঁজে পায়, উল্লাসের চিহ্ন ছড়িয়ে পড়ে চোখে-মুখে। নার্গিস নামের মেয়েটি অতি উৎসাহে বলে, আমারটাও দেখব।
আমার মনটা গভীর বিষাদে ছেয়ে যায়। সবার মধ্যে কেবল এই মেয়েটিই চোখে দেখতে পায় না। আমি বিষাদ চেপে তাকে মিথ্যা বলি, তুমি দেখবা কিন্তু এখন তো দেখতে পারবা না। নীচুস্বরে শিখিয়ে অন্যদেরকে  বলি, এই তোমরা বলো নার্গিসের ছবি কেমন এসেছে। সবাই সমস্বরে বলে, সুন্দর। আমি আবারও বলি, কত সুন্দর? ওরা এবার উচুস্বরে বলে, অনেক সুন্দর। নার্গিসের মুখ হাসিতে ভরে যায়।
জানি না হয়তো মনটা ভারী বিষণ্ন ছিল কি না, নার্গিস নামের এই অভাগা মেয়েটার হাসিমাখা ছবি উঠাতে মনে থাকেনি, মনে থাকলে ভাল হতো। খুব ইচ্ছা করছে এই অভাগা মেয়েটার হাসিটা দেখতে...।

সহায়ক লিংক:
১. স্বপ্ন: http://tinyurl.com/3y7bpz3
২. ঈশ্বরের বিশেষ সন্তানদের ইশকুল: http://www.ali-mahmed.com/2010/07/blog-post_22.html   

4 comments:

আপনার যে কোন মত জানাতে পারেন নিঃসঙ্কোচে, আপনি প্রাসঙ্গিক মনে করলে।