*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Thursday, June 28, 2007
একজন গোলাম আযম- একটি পতাকা!
*জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর গোলাম আযম বলেন, আমার জন্য ১৮ জন শহীদ হয়েছে, এ কথা ভাবতে খারাপ লাগে, আবার ভালোও লাগে। (সূত্রঃ ভোরের কাগজ/ ১৬.০৭.৯৩)
*গত বছরের ২৪ মার্চ গোলাম আযমকে ফরেনারস এ্যাক্ট-এ আটক করা হয়েছিল। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি দেয় হয়হাইকোর্ট বিভাগের এক রায়ে। সকাল ১১টা থেকেই সহস্রাধিক জামাতী কর্মী নাজিমউদ্দিন রোডে তান্ডব সৃষ্টি করে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তারা কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন সমস্ত সড়ক বন্ধ করে দেয়।
গজারী লাঠির সংগে জাতীয় পতাকা বেঁধে তারা ওই জাতীয় পতাকা কখনো দুমড়ে মুচড়ে রাস্তায় ফেলে রাখে। আবার কখনো জাতীয় পতাকা ব্যবহার করে বসবার কাপড় হিসাবে।
মাইক এনে বসায়, দুপুর ২টায়- ঠিক জেল গেটের প্রধান ফটকের সামনে। পুলিশ এতে বাঁধা দেয়নি। মাইকে প্রথমে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেয়া হয়, এসব বক্তৃতায় সরকারকে শুধু হুমকি ধামকিই নয়- কেন্দ্রীয় কারাগার জ্বালিয়ে দেয়ার প্রকাশ্য হুমকিও ছিল! পুলিশ কর্মকর্তাদের এসব বক্তব্যে সামান্যতম উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায়নি। এক পর্যায়ে একটি দল গেয়ে চটুল গান গেয়ে উঠে, হাওয়া হাওয়া তুই কি শুনেছিস—!
জামাতের এক নেতা জানালেন, এটা গান নয় শ্লোগান। এ সময় জামাত এবং পুলিশ একাকার হয়ে যায়! জামাতী কর্মীরা পুলিশের ভ্যান দখল করে সেখানে বসে গোলাম আযমের নামে জিকির করতে থাকে।
বিকেল ৫টা দিকে জামাতীরা গোলাম আযমের মুক্তির আশা ছেড়ে দিয়ে জনসভার উদ্যোগ নেয় জেল গেটের সামনেই। অথচ ওই স্থানে সমাবেশ করা সম্পূর্ণ বেআইনী! সাড়ে ৫টার দিকে জামাতের শীর্ষস্থানীয় নেতারা এসে ফিসফিস করে জানিয়ে যান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে- আজই মুক্তি হবে। ৬টা ৪০ মিনিটে গোলাম আযম বেরিয়ে আসেন জেল গেট দিয়ে! (ভোরের কাগজ/ ১৬.০৭.৯৩)
***************
চারিদিকে বিভিন্ন দেশের খেলার পতাকা উড়ে- আমরা উত্সাহ উদ্দীপনা, আবেগ নিয়ে অন্য দেশের পতাকা উড়াই, চকচকে ১০-২০গজের পতাকা! আমাদের স্বাধীনতা দিবসেও তো এতো আবেগ নিয়ে উড়ে পতাকা উড়ে না।
অনেকে এ মন্তব্যে তীব্র আপত্তি জানাবেন- খেলার পতাকার সঙ্গে এই উদাহরণ দেয়ার কোন যুক্তি নাই। কিন্তু এই আবেগ নিয়ে আমরা কি জাতীয় পতাকা উড়াই- আমার স্বচক্ষে দেখা, স্বাধীনতা দিবসে বিবর্ণ, দোমড়ানো মোচড়ানো এক পতাকা লম্বা ঝাড়ুর হাতলে বেঁধে উড়ানো হয়েছে।
বিশেষ একটা দিনে কুমিরের ছানার মতো চোখের জল ফেলে এই দেশমার ঋণ শোধ করি! হালুয়া পুরি খেয়ে ভোট দিতে যাই- এই দেশবিরোধীদের গাড়ীতে পতাকা লাগাই, আমাদের মগজ গুহ্যদ্বারে জমা রেখে!
আসলে পতাকা পতাকাই- এক টুকরো কাপড় ব্যতীত অন্য কিছু না!
মুক্তিযুদ্ধ একটি ফ্যাশানের নাম
সম্প্রতী একজন ঠিক এমন একটা গালিই দিয়েছেন আমাকে, আমার সম্বন্ধে দেশবিরোধী বলে সংশয় প্রকাশ করে। না, সামনাসামনি না, লেখায়। এই মানুষটার এমন স্পর্ধা নাই আমার চোখে চোখ রেখে তার এলোমেলো বক্তব্যটা বলতে পারবেন।
মানুষটার দুঃসাহস দেখে আমি হতভম্ব! হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠা আমার জন্য খুব একটা সমস্যা ছিল না। এই মানুষটাকে মনে রাখার মতো কোন স্মৃতি আমার নাই- এমন কোন দুঁদে মানুষ না তিনি, আমার দৃষ্টিতে। কিন্ত আমি পাথর হয়ে যাই যখন দেখি আমার ক-জন সহযোদ্ধা এই নিয়ে টুঁ শব্দ দূরের কথা, প্রতিবাদ দূরের কথা, নিরাসক্ত ভঙ্গিতে দেখলেন।
বেশ-বেশ! নিজের হাতের আঙ্গুলের মত সহযোদ্ধাদের চেনাটাও বড়ো জরুরী! ফ্রিডম নামের মুক্তিযুদ্ধের একটা বই আছে আমার। একজন দুর্বল মানুষের দুর্বল প্রচষ্টা আর কী- কিঞ্চিৎ দেশমার ঋণ শোধের অপচেষ্টা!
তো, আমি এই বইটি একজনকে দিয়েছিলাম, পড়ার জন্য। একবার জানতে চাইলাম, আচ্ছা, বইটায় আপনি কোন সমস্যা পেয়েছেন?
তিনি বললেন, আমি তো পড়িনি। আপনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন- পড়ার প্রয়োজন কি?
আমি হতবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। যদি তিনি বলতেন, আপনার লেখা কিচ্ছু হয়নি, এতে আমার মন্দ লাগার কিছু ছিল না। নিজেকে শোধরাতে পারতাম।
আসলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভারী গোলমাল হয়ে গেছে এখন। কারও কারও বদ্ধমূল ধারণা, বিশেষ একটি দলই এই দেশ স্বাধীন করে ফেলেছে- অন্য আর কারও অবদান ছিল না। ভাঙ্গা রেকর্ডের মত এদের কথা বলে চর্বিতচর্বণ করছি আমরা। আমরা মনে রাখি না ১০ বছরের লালুর কথা, হিন্দু বালিকা ভাগিরথী, একমাত্র আদিবাসী বীর বিক্রম উক্য চিং এর কথা!
আমি ব্যতীত অন্তত অন্য ২ জনকে একই দোষে দুষ্ট করা হয়েছে। ১ জনের বিষয়ে বলি। ওঁর মনন স্পর্শ করার ক্ষমতা অনেকেরই নাই- তাঁর দেশের প্রতি মমতার অভাব আছে বলে আমি মনে করি না।
অন্যজন আমাকে দিয়েছেন তাঁর কিশোরকাল থেকে জমানো মুক্তিযুদ্ধের দূর্লভ সব পেপার কাটিং। যে কিশোরটি বুকে লালন করে আসছে একগাদা মমতা- এত বছর পর সে রাজাকারসম হয়ে গেল। বাহ! এইজন্য কি, এঁরা আপনাদের মত মানুষদের সঙ্গে ঝাকের কৈ হতে পারেন না।
কে বোঝাবে এদের- একেকজনের কাজ করার ভঙ্গি একেক রকম!
কে জানে, সেই দিন খুব দূরে না, মুক্তিযুদ্ধ হবে একটি ফ্যাশনের নাম। বুঝে না বুঝে, কষে কুৎসিত গালি দিয়ে আমরা ক্রমশ পরিণত হবো একটা জাঁকালো মুক্তিযুদ্ধ ফ্যাশনবাজরূপে!
ইচ্ছা হলেই কাউকে দুম করে রাজাকার বলা যায় না
"সাবেক জ্বালানী উপদেষ্টা এবং বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান, মি. মাহমুদুর রহমান, আপনি খেপে উম্মাদ হয়ে গেলেন কেন? সমস্যাটা কী আপনার?
ঘটনার সূত্রপাতঃ মাহমুদুর রহমানকে নাকি সিপিডি-র মঞ্জুর এলাহী রাজাকার বলেছেন। ৯ আগস্ট, ০৬-এ দৈনিক ইত্তেফাকে সেন্ট্যাল ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এর সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর উদ্ধৃতি দেয়, মাহমুদুর রহমানকে অনেকে রাজাকার বলেন।
মাহমুদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমি প্রমাণসহ দেখিয়ে দিচ্ছি, আমি রাজাকার ছিলাম না। আমার নামে মিথ্যা তথ্য দেয়া হয়েছে। আমি আইনগত ব্যবস্থা নেবো। আমাকে রাজাকার বা কোলাবরেটর বলায় বিদেশী বিনিয়োগকারী কি ভাববে?
৯ আগস্ট, বুধবার মাহমুদুর রহমান ঢাকার সিএমএম কোর্টে হাজির হয়ে সিপিডির বিরুদ্ধে একটি মানহানীর মামলা দায়ের করেন। আদালত থেকে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী হয়। পরে তাঁরা আগাম জামিন নেন।
আহ-হা, মাহমুদুর রহমান তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন, রাজাকার ভালো একটা পদবী না; যে পদবী থাকলে বিদেশে ভাবমূর্তির সমস্যা হয়। অন্যায়ভাবে কেউ রাজাকার বললে গায়ে আগুন ধরে যায়! আপনার দলের মাথার উপরে যখন রাজাকাররা বনবন করে ছড়ি ঘুরাচ্ছে, সেখানে আপনি রাজাকার শব্দটা ভারী অপছন্দ করেন, বেশ-বেশ! কী কান্ড, নোংরা আবর্জনাটা নিজের উপর পড়লে বুঝি ভালো লাগে না? তখন রাজাকার শব্দটা কুৎসিত গালি মনে হয়?
আলোচ্য বিষয় এটা না, মঞ্জুর এলাহী আসলে বলেছেন, কি বলেন নাই মাহমুদ রহমান কি আসলেই রাজাকার, না রাজাকার না? আলোচ্য বিষয় এটাও না, মামলার কি মেরিট আছে, কি নাই!
আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, আমি মনে করি, মাহমুদুর রহমানের এই মামলাটির গুরুত্ব অপরিসীম! এই মামলায় প্রত্যক্ষ জয় হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের এবং পরাজয় হয়েছে রাজাকারদের। প্রমাণিত হয়েছে, রাজাকার একটি ঘৃণ্য গালি এবং অহেতুক কেউ এই গালি দিলে মামলা করা যায়; গ্রেফতারী পরোওয়ানাও জারী করা যায়!
***
দুধের রং সাদা, এটা হচ্ছে জ্ঞান; শেখার সময় এটাই শিখবো। দুধটা সাদা গরুর, নাকি কালো গরুর, সেটা এখানে আলোচ্য বিষয় না! এটাও আলোচ্য বিষয় না, দুধের সঙ্গে স্ট্রবেরী মিশিয়ে, না আঙ্গুর মিশিয়ে কেমন রং বানানো হয়েছে!
২য় বিশ্বযুদ্ধ কি ৭১ এর আগে হয়েছে, না পরে? এখনো জাপান তার কৃতকর্মের জন্য লজ্জায় শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারে না, বিনীত হাত ঘসতে ঘসতে হাতের রেখা মুছে যাওয়ার উপক্রম। নাৎসিরা এখনো ধিকৃত হয়।
অসাধারণ একজন মানুষ, নোবেল বিজয়ী গুন্টার গ্রাস, জীবনের শেষ সময়ে এসে ধিকৃত হচ্ছেন। কেন, তাঁর নাৎসি কানেকশনের জন্য। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন কিন্তু পৃথিবীব্যপী সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে! আরেক নোবেল বিজয়ী লেচ ওয়ালেসা বলেছেন, গুন্টার গ্রাস যখন ২য় বিশ্বযুদ্ধে তার ভূমিকার কারণে বিতর্কিত, গুন্টারের উচিৎ হবে পোলিশ শহর গদানস্কের সম্মানসূচক নাগরিক এই খেতাবটি স্ব ইচ্ছায় ছেড়ে দেয়া। ১৯২৭ সালে গুন্টার গ্রাস পোলিশ শহর গদানস্কে জন্মগ্রহন করেন।
সো গাইজ, আমরা সাদাকে সাদা বলবো, কালোকে কালো! রাজাকারকে রাজাকার বলবো সাধুকার না, দ্যাটস অল! রাজাকারকে কে চুমো দিল, কে কোলে বসালো, তাতে আমাদের কী আসে যায়!
হায়, পায়ের নীচে মাটি নাই!
ড. মুহম্মদ জাফর সাদাসিদে কথায় ‘একজন অসুখী রাষ্ট্রপতি’ নামে একটি কলাম লিখেন (০৩.১১.০৬)। পড়ে বিষণ্ন হই। কেন যেন আমার মনে হচ্ছে, এইসব আলোকিত মানুষরা, এঁরা যদি এমন করে ভাবেন, লিখেন তখন ক্রমশ পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যায়!
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন: 'আমার কেন জানি মনে হয়, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে অসুখী মানুষ রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। ...তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি শুধু অসুখী নন, তিনি ক্লান্ত, ভীত এবং আতঙ্কিত। রাষ্ট্রপতির আশেপাশে মিলিটারী পোশাক পরা এতো লোক থাকে আমি জানতাম না...।'
বেশ-বেশ! কাউকে অসুখী মনে হওয়া দোষের কিছু না কিন্তু রাষ্ট্রপতির আশেপাশে মিলিটারী পোশাক পরা লোকজন থাকেন, এটা মনে হয় অভূতপূর্ব ঘটনা? নিরাপত্তার জন্য টোকাই শ্রেণীর কেউ থাকে বলে তো শুনিনি! আপনার বিভিন্ন লেখায় পড়েছি বলেই জানি, মিলিটারীর উপর দেখি আপনার ভারী রাগ! এই মিলিটারী তো পাক-মিলিটারী না, এরা তো এ দেশেরই সন্তান! কারও বাবা, কারও ভাই...।
'তাঁর (অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ) এ দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা ছিল না, অধ্যাপক বি, চৌধুরীকে অসম্মান করে সরিয়ে দেয়ার পর প্রায় হঠাৎ করেই তাঁর ওপর এ দায়িত্বটি এসে পড়ে...।'
আচ্ছা! তাঁর ওপর দায়িত্বটি এসে পড়ে, বাংলাদেশের কোন সংবিধান অনুযায়ী? আমার যতটুকু মনে পড়ে, তিনি স্বইচ্ছায় এই পদটি আগ্রহের সঙ্গে বেছে নিয়েছিলেন। বন্দুকের মুখে কেউ এই দায়িত্বটি নিতে বাধ্য করেছিল বলে তো শুনিনি। আমার তো মনে হয়, বি চৌধুরীর অসম্মানের সঙ্গে বিদায়ের পর কোন সচেতন-মর্যাদাবান মানুষের এই পদ নেয়াটা সমীচীন ছিল না!
হিষ্ট্রি রিপিট!
'১৪ দলের কর্মীদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ এবং ক্রোধ বিস্ফোরনের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণটুকু একটা ষড়যন্ত্রের মতো, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা, ক্রোধোম্মত্ত কর্মীরা হাতের লগি এবং বৈঠা নিয়ে এখন কি করবে...?'
আহা! সিম্পল উত্তর, মাথা ফাটাবে, পিটিয়ে মানুষ মারবে।
'তখন হাসিমুখে শেখ হাসিনা যেভাবে পুরো বিষয়টি গ্রহন করলেন তার কোন তুলনা নেই। পুরো দেশটিকে তিনি যেভাবে একটা ভয়ঙ্কর সংঘাত থেকে রক্ষা করে দিলেন, দেশের সব মানুষ সেটি মনে রাখবে। আমি খোদার কাছে তখন শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করেছি। আমার ধারণা শুধু আমি নই, এই দেশের লাখ কোটি মানুষ তার জন্য দোয়া করছে।'
অট্টহাস্য দেয়া ব্যতীত আমার বলার কিছুই নেই!
'ফিরে আসার পর তাকে ( রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দি আহম্মেদ) সিএমএইচে আটকে রাখা হলো। তিনি আবার বঙ্গভবনে ঢুকতে পারবেন বলে মনে হচ্ছিল না, অধ্যাপক বি, চৌধুরীর অপসারণ প্রক্রিয়া থেকে অল্প একটু বেশী সম্মানজনক প্রক্রিয়া! সেই সময়কার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা তখন অনেক বাগবিতন্ডা করে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে বঙ্গভবনে সম্মানজনকভাবে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন...।'
আহা! ক্ষমতার যার এমন মায়া, তাঁর আবার সম্মান অসম্মান নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন কী! ৭৬ বছর বয়স্ক, ২ কোটি টাকা দামের দুর্বল হৃদপিন্ডের একজন মানুষের প্রয়োজন কী বাড়তি দায়িত্ব নেয়ার, আর প্রয়োজনই বা কি বেছে বেছে জটিল ১১ টি দপ্তর নেয়ার!
এই কষ্ট কাকে বলি, বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের এই সাবেক অধ্যাপক, যিনি বাংলা ভাষাটা শুদ্ধ করে উচ্চারণ করতে পারেন না! তাঁর এক ভাষণে পাঁচ মিনিটের মাথায় আমি ২২টা অশুদ্ধ শব্দ নোট করে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম।
জাফর ইকবাল নিজে শিক্ষক বলেই সম্ভবত অন্য শিক্ষকের প্রতি পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট! হরতাল নিয়ে জনাব ইকবালের বাকেয়াজ একটা কলাম ছিল, শিক্ষা বিভাগকে হরতালের আওতামুক্ত রাখার আবেদন। বাহ, কী চমৎকার কথা, একজনের মুখের কথায় ১৪ কোটি মানুষ একটা কারাগারে আটকা পড়বে, বছরের পর বছর এটা চলতেই থাকবে, গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে! স্যার, শিক্ষা বিভাগ হরতালের আওতার বাইরে থাকলে, একজন ছাত্রী ঢাকা থেকে সিলেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে কিসে করে, ঘোড়ায় করে নাকি এম্বুলেন্সে চড়ে?"
এরপর পানি অনেক গড়িয়েছে। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে (মতান্তরে ইয়েসউদ্দি আহম্মেদ) নিয়ে কী লিখতেন? নাকি শিক্ষক-মমতায় সোনালী রোদে বুঁদ হয়ে পক্ষপাতদুষ্টই থেকে যেতেন! জানতে বড় ইচ্ছা করে।
অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ শিক্ষক লিখিত বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন, পত্র-পত্রিকায়, 'ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ আমাদের সহকর্মী ছিলেন এই কারণে আমরা লজ্জিত'।
কিন্তু ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নামক মানুষটা কোন লাজ ছিল বলে অন্তত আমার মনে হয় না। তিনি ছিলেন নির্বিকার, ক্ষমতার লোভে। শনৈঃ শনৈঃ ক্ষমতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সীমাহীন ক্ষমতার লোভে তার জিভ সক সক করছিল।
এমন ক্ষমতার লোভ রাজনীতিবিদদের থাকে বলে আমার ধারণা ছিল কিন্তু একজন শিক্ষত-মর্যাদাবান মানুষের মধ্যে এটা বিরল!
৭১-এ নিধন- ড. আবুল খায়ের
একদিনের ঘটনা। তিনি নিজেই গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছেন। সিগনালের লাল বাতি দেখে গাড়ী থামালেন। লাল বাতী সবুজ হলো । আবার লাল হলো কিন্তু এই আত্তভোলা মানুষটা গাড়ী থামিয়ে চুপচাপ গাড়ীতে বসে আছেন।
কিন্তু আল বদররা এই আলাভোলা মানুষটাকেও ক্ষমা করেনি!
ড· আবুল খায়েরের ফ্ল্যাট ছিল নীচ তলায়।
১৪ ডিসেম্বর। সকাল ৮টা।
ঘুমাবার পোষাক পায়জামা, শার্ট পরেই তিনি পায়চারী করছেন। এই আলাভোলা মানুষটা, তাঁর গায়ের চাদরটা যে তাঁর স্ত্রীর- খেয়ালই করেননি।ভাবছিলেন, কারফিউ উঠে গেলেই তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাবেন- তাঁর স্ত্রী বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন।
এমনি সময় আল বদরের লোকজন এসে হাজির। তাঁকে ঠিক ওই অবস্থায়ই ধরে নিয়ে গেল। আল বদরদের সঙ্গে তাঁর কি কথা হয়েছিল, তা কেউ শোনেনি!
ড· আবুল খায়ের তাঁর স্ত্রীকে কিছু বলে যেতে পারেননি!
* সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, অষ্টম খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ৬২৪
(এই মানুষটার শেষ কথা আমরা জানি না। কেউ কোন দিন আর এটা দেখবে না, সিগনালের বাতী লাল থেকে সবুজ হচ্ছে, সবুজ থেকে লাল- কিন্তু একটা গাড়ী থেমে আছে। ভেতরে একজন মানুষ বসে আছেন। বসে আছেন তো বসেই আছেন। চারদিকে হইচই অথচ মানুষটার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই- একমনে কি যেন ভাবছেন। আলাভোলা, বুদ্ধিদীপ্ত এই মানুষ- যার চোখগুলো অসম্ভব ঝকঝকে- যার চোখে আটকে থাকে গোটা সুর্যটা!)
একমাত্র আদিবাসি বীর বিক্রম, উক্য চিং
ওখানে মিসেস রাবেয়া খাতুনকে নিয়ে যে লেখাটা লিখেছিলাম:
https://www.facebook.com/ali.mahmed1971/posts/10151488939132335
ওখানে তাঁর বর্ণনার সবটা আমি কিন্তু দেইনি কেবল "এদের উপর শুধু চরম শারীরিক অত্যাচারই করেই এরা থেমে থাকেনি- অবলীলায় কেটে ফেলেছে, ছিঁড়ে ফেলেছে শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো...!"
এটা লিখে মেয়েদের উপর নির্যাতনের ভয়াবহতা, বীভৎসতা বোঝাবার চেষ্টা করেছি। আমাদের নারীদের প্রতি পাক-বাহিনীর আচরণ এমন বীভৎস ছিল যার বর্ণনা লিখতেও বুকের জোর লাগে। সেই জোর আমার নাই! এসব পড়ার জন্যও আসলে শক্ত নার্ভ দরকার! আমি যেটা আগেও বলেছি, পাক-আর্মি, এরা আসলে যোদ্ধা ছিল না, ছিল সাইকোপ্যাথ! এই সাইকোপ্যাথদের পুরুষাঙ্গ কেটে রাস্তায় শুইয়ে রাখার মত প্রতিবাদ করেছিলেন, 'উক্য চিং'। জঙ্গলে চলে কেবল জঙ্গলের আইন...।
৭১ এর ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যার হাতে এলএমজি, গ্রেনেড, মর্টার গর্জে উঠেছে বারবার। মাতৃভূমিকে বর্বর পাক-হানাদার বাহিনীর কবল থেকে স্বাধীন করতে মরণপণ যুদ্ধে যিনি ১৩ জন সদস্য নিয়ে অংশগ্রহন করেছেন। দুঃসাহসী এ যোদ্ধার প্রতিটি অভিযান শত্রুসেনার ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। একের পর এক বর্বর পাকিস্তানি সেনারা লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে।
কেবল একটা ঘটনার কথা বলি: ভুরুঙ্গমারীর যুদ্ধে উক্য চিংদের সাফল্য ছিল অন্যদের জন্য অহংকার করার মত! মুক্তাঞ্চল থেকে স্বয়ং মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ছুটে এসেছিলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যুদ্ধের সাফল্যের কারণ জানতে চেয়েছিলেন। তিনি খোঁজ নিয়ে দেখেন, উক্য চিংদের বান্কারের মুখে একটা এলএমজির ট্রিগারে রশি বেঁধে সেই রশিটিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অনেক দূরে। সেখান থেকে রশিতে টান দিয়ে অনেকটা রিমোট কন্ট্রোলের মত এলএমজি ব্যবহার করা হয়েছে!
উক্য চিং একবার একটি ছোট্ট ব্রিজের নীচে সার্চ করে দেখেন সাত-সাতটি রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন নারীদেহ। তখনও কারো জামায় শোভা পাচ্ছে ঝকঝকে ফাউন্টেন পেন। বুঝতে সমস্যা হয় না এরা স্কুল-কলেজের ছাত্রী, বয়স ১৬ থেকে ১৮। পাক বাহিনী দ্বারা চরম পৈশাচিক নির্যাতনের পর এদের হত্যা করে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে।এই উক্য চিং, যিনি বাঙালী নারীদের ওপর পাক সৈন্যদের বর্বর নির্যাতনের প্রতিবাদে পাক বাহিনীর এক কমান্ডারসহ সাত সেনাকে ধরে তাদের পুরুষাঙ্গ কেটে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রেখেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার যে অল্প পড়াশোনা কিন্তু তারপরও আর কোথাও এমন প্রতিবাদ আর কেউ করেছিলেন বলে অন্তত আমার জানা নাই। অথচ এই অগ্নিপুরুষকে এক বিজয় দিবসে বান্দরবান টাউন হলে ১০০ টাকার প্রাইজ বন্ড দিয়ে সম্মানিত (!) করা হয়েছিল!
অশ্রুসজল চোখে উক্য চিং বীর বিক্রম তখন প্রশ্ন রেখেছিলেন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা ২০০০-এর কাছে:
'কেন এই প্রাইজ বন্ড দিয়ে আমাদের লজ্জা দেয়া'?
উক্য চিং বীর বিক্রম বললেন, ‘দ্যাখেন, করাচি থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসে ‘৭১ সালে কেমন গোল খেয়ে গেল পাকিস্তানিরা! বলেই হা-হা- করে হেসে উঠলেন। কথা বলছেন আর বুকে ঝোলানো মেডেলগুলো ঝন ঝন করে উঠছে।
এডামুই পাইং সংঘ থেকে গত তিন বছর ধরে উক্য চিং এর নামে মেধা বৃত্তি চালু হয়েছে। প্রথম শ্রেণীর স্কুল-ছাত্র ‘অনীক’ জানে না কার নামে এ বৃত্তি, কেন এ বৃত্তি কী তার ভূমিকা?
অনীকের দোষ দিয়ে লাভ কী! আমরা স্বাধীনতার এতো বছর পরও বেমালুম ভুলে গেছি আরেকজন আদিবাসি-আদিনারি প্রিনছা খেঁ-র কথা। ভাগিরথীর কথা। কী অবলীলায় ভুলে যাই, লালু'র কথা।) ঠিক ১৬ ডিসেম্বরে মুক্তিযোদ্ধঅ সুরুয মিয়া আত্মহত্যা করলে এতে আমাদের কোন লাজ নাই! আসলে ভুলে যেতে হয় কারণ এখন মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে একটা বিক্রয়যোগ্য পণ্য! যে যেভাবে পারছে বিক্রি করছে!
বীরাঙ্গনা রীনা, তোমায় স্যালুট করি
ওরা আমাদের বাড়িতে একা ফেলে রেখে দেশের কাজে গিয়েছিল এ কথা সত্যি; কিন্তু আমাদের রক্ষা করবার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল কার ওপর? একবারও কি আমাদের পরিণামের কথা ভাবেনি? আমরা কেমন করে নিজেকে বাঁচাবো, যুদ্ধের উন্মাদনায় আমাদের কথা তো কেউ মনে রাখেনি। পেছনে পড়েছিল গর্ভবতী স্ত্রী, বিধবা মা, যুবতী ভগ্নী কারও কথাই সেদিন মনে হয়নি।
অথচ তাদের আত্মরক্ষার তো কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। বৃদ্ধ পিতা-মাতা মরে বেঁচেছেন, গর্ভবতী পত্নীর সন্তান গর্ভেই নিহত হয়েছে। যুবতী স্ত্রী, তরুণী ভগ্নী পাক দস্যুদের শয্যাশায়িনী হয়েছে। অথচ আজ যখন বিজয়ের লগ্ন এসেছে, মুক্তির মুহূর্ত উপস্থিত হয়েছে তখনও একবুক ঘৃণা নিয়ে তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করছে সামাজিক জীবেরা।
আজ পথে পথে কতো শহীদ মিনার। কতো পথ ঘাট কালভার্ট সেতু আজ উৎসর্গিত হচ্ছে শহীদদের নামে। শহীদের পিতা, মাতা, স্ত্রী সন্তানেরা কতো রাষ্ট্রীয় সহায়তা সহানুভূতিই শুধু নয়, সম্মান পাচ্ছে কিন্তু আমরা কোথায়? একজন বীরাঙ্গনার নামে কি একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে? তারা মরে কি শহীদ হয়নি?
একটি মেয়ে তার জীবনের যা কামনা করে তার আমি সব পেয়েছি। তবুও মাঝে মাঝে বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে ওঠে। কিসের অভাব আমার, আমি কি চাই? হ্যাঁ একটা জিনিস, একটি মুহুর্তের আকাঙ্ক্ষা মৃত্যু পর্যন্ত রয়ে যাবে। এ প্রজন্মের একটি তরুণ অথবা তরুণী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, বীরাঙ্গনা আমরা তোমাকে প্রণতি করি, হাজার সালাম তোমাকে।
ঋণঃ আমি বীরাঙ্গনা বলছি (নীলিমা ইব্রাহীম)
*অসাধারণ একটা বই আমি বীরাঙ্গনা বলছি। এই বইটা আমি যখন পড়ি, আমার খুব অস্থির লাগছিল। ওই সময়কার কথা বলছি, যখন আমার জানাশুনা মানুষ খুব কম। বীরাঙ্গনা রীনার তেমন কোন তথ্য কেউ দিতে পারলেন না। শেষ প্যারাটা আমার মাথায় আটকে গেল। কেবল ঘুরপাক খায় এই কথাগুলো। আমার অল্প ক্ষমতায় কীই বা করতে পারি! আমি আমার ফ্রিডম বইটা তাঁকে উৎসর্গ করেছিলাম। খানিকটা কষ্ট কমেছিল।
আমার এই বইয়ের প্রকাশক আমাকে বললেন, আপনি উৎসর্গে এইসব কি লিখেছেন।
আমি বললাম, আমি যা বিশ্বাস করি তাই লিখেছি। আপনি যদি এই মানুষটাকে বইমেলায় হাজির করতে পারেন, আমি সত্যি সত্যি এই কান্ডটা করব। হাজার হাজার মানুষের সম্মুখে- এতে আমার কোন লাজ নাই।
ফ্রিডমের উ ৎসর্গে আমি লিখেছিলাম, উ ৎসর্গঃ বীরাঙ্গনা রীনা, প্রকাশ্যে ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার পা ধরে রাখব, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি বলবেনঃ এ প্রজন্মকে ক্ষমা করেছেন।
একজন বীরাঙ্গনা, একজন জজ সাহেব, একটি পতাকা
"...'আমি শেফা...। ফারুক আমাদের কলেজে বি.এ পড়ত। কেমন যেন গোবেচারা বোকা বোকা গোছের। বাবাকে একদিন বলেছিলাম, 'জানো বাবা, ফারুক কখনও মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকায় না'।
মা বললেন, 'অমন ছেলে আজকালকার দিনে হয় না'।
বাবা বললেন, 'দ্যাখো গিয়ে ছোটবেলায় মাদ্রাসায় পড়েছে। আমাদের সঙ্গে যে সব মাদ্রাসায় পড়া ছেলে কলেজে পড়তো তারাও মেয়েদের দিকে সোজাসুজি তাকাতো না, কিন্তু সুযোগ পেলে ওরাই সব চেয়ে বেশী হ্যাংলার মতো মেয়ে দেখত। হাসাহাসির ভেতর ফারুকচর্চা শেষ হতো'। ...
কেমন করে চলে এলো ২৫শে মার্চ । বাবা, মায়ের জেদে গ্রামে চলে গেলেন একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও। বাবা আমাদেরকে গ্রামে যাবার জন্য খবর পাঠালেন।
...হঠাৎ একদিন আমার ছোট ভাই অদৃশ্য। ১৭/১৮ বছরের ছেলে। ছোট্ট কাগজে মাকে আর আমাকে লিখে গেল, 'যুদ্ধে যাচ্ছি, তাড়াতাড়ি দেশে চলে যাও'। মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। বললেন, 'ফারুককে খবর দে'।
...আজ রাতেই (আমরা) দেশে চলে যাব।
ঠিক সন্ধ্যায় ফারুক বলল, 'খালাম্মা, চলে যাচ্ছেন, চলুন আমি পৌছে দিয়ে আসি'।
দু'খানা বেবীট্যাক্সি ডাকা হলো। আমি মার সঙ্গে যেতে চাচ্ছিলাম কিন্তু ফারুক আমাকে তারটায় (বেবীট্যাক্সিতে) উঠতে বলল। মা আর সোনালী (ছোটবোন) সামনেরটায় উঠল। কিছুদুর যাবার পর আমাদের বেবীট্যাক্সি সোজা স্টেশনের পথে না গিয়ে বাঁ দিকে সেনানিবাসের পথ ধরল।
(আমি) চিৎকার করে বললাম, 'এই বেবী থামো'।
না, সে (বেবীট্যাক্সির ড্রাইভার) তার গতি বাড়িয়ে দিল। আমি লাফ দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্ত ফারুক সঙ্গে গায়ের শক্তিতে না-পেরে, ওর হাতে আমার সব কটা দাঁত বসিয়ে দিলাম। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল পশুটা। তারপর বেবীট্যাক্সি থামিয়ে ওই জানোয়ারটা আমার মুখ বাঁধলো। তারপর সোজা সেনানিবাস। আমি বন্দী হলাম।
ফারুক আমাকে উপহার দিয়ে এলো (সেনানিবাসে)!
...ফারুক এখন জজ সাহেব। আর কখনোও (ফারুক) হাফ শার্ট পরে না। তবে কেউ হাতের দাগ দেখে ফেললে বলে মুক্তিযুদ্ধে আহত হয়েছিল বেয়ানাট চার্জে।
দেখুন, তাহলে এ দেশে মুক্তিযোদ্ধা কারা!...
এরপর সব আমার কাছে দুঃস্বপ্ন। অবশেষে একদিন। 'জয় বাংলা' ধ্বনি আরও জোরদার হচ্ছে।
কয়েকজনের মিলিত কন্ঠ, 'এবারে মা, আপনারা বাইরে আসুন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা আপনাদের নিতে এসেছি'।
কিন্তু এত লোকের সামনে আমি সম্পূর্ণ বিবস্ত্র, উলঙ্গ। দৌড়ে আবার বাংকারে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বিশাল এক পুরুষ, এক শিখ আমাকে আড়াল করে দাঁড়ালেন, তাঁর মাথার পাগড়িটা খুলে আমাকে যতোটুকু সম্ভব আবৃত করলেন। তিনি বারবার বলছিলেন, 'আপনি আমার মা-আপনি আমার মা। সন্তানের কাছে মার কোনো লজ্জা নাই...'।
..."
*ছবিটি পোস্টের চরিত্রের না।
একটি ভাল ভুল- একটি খারাপ ভুল!
ইস্তারি(!) সাহেবা: আজ তারিখটা কত?
আমি অবাক: কেন, বাসায় কী তারিখের যন্ত্র, আ মীন, কেলেন্ডার-ফেলেন্ডার নাই!
ইস্তারি সাহেবা (হিম গলায়): থাকুক, তুমিই বল না, শুনি একটু।
আমি (গলায় আলগা কাঠিন্য এনে): এটা রসিকতা করার সময় না। কাজের সময়।
ইস্তারি সাহেবা: আমার সঙ্গে চালবাজী করবা না, তুমি কলম চালানো ছাড়া যে অন্য কোন কাজ পারো না সে আমি বিলক্ষণ জানি। আমার সঙ্গে চালবাজি করবা না, আমি তোমার ছাতাফাতা আবর্জনা লেখার পাঠক না। তোমার কলমবাজি ওদের জন্য তুলে রাখো। এ্যাহ, ভারী একজন কলমচি হয়েছেন তিনি, এক পাতা লেখতে ১০টা বানান ভুল!
আমি (চিঁ চিঁ করে): বিষয় কি, তারিখের সঙ্গে লেখালেখির সম্পর্ক কী! আজ ৭ মে, তো?
ইস্তারি সাহেবা: তো! লজ্জা করে না তো বলতে, চশমখোর কোথাকার। বুড়া কুইচ্চা মাছ! তোমার সঙ্গে কথা বলতে এখন আর ভাল্লাগছে না।
আমি (হড়বড় করে): শোনে শোনো, ফোন...।
ফোন কেটে দিলে আমি আকুল পাথার ভাবছি। কাহিনী কী! ৭ই মে, এই দিনে কি প্রলয় হয়েছিল যে মনে না রাখলে মাথা কাটা যাওয়ার দশা। এই দিন কি আমেরিকা জাপানে আনবিক বোমা ফেলেছিল- কেন আমার মনে রাখা প্রয়োজন? ১৩১০ গ্রাম মস্তিষ্কের উপর চাপ পড়ছে। লাভ কী, এই দুর্বল মস্তিষ্কের সেই শক্তি কই! আচ্ছা, আজ সকালেই বাসায় ফোটা মে ফ্লাওয়ার দেখে কি যেন একটা ভাবনা এসেও তাল কেটে গিয়েছিল? ইয়া মাবুদ, আজ থেকে ১০ বছর আগে এই দিনই বিবাহ করেছিলাম। একটি ভাল ভুল!
পায়ে কুড়াল মারা হলো নাকি কুড়ালে পা মারা হলো এ নিয়ে গবেষণা করার আর কোন অবকাশ নাই। কিন্তু দেখো দেখি লোকজনের কান্ড, এরিমধ্যে আমার এক সুহৃদ ফোন করে ইস্তারি সাহেবাকে ১০ বছর আগের করা আমার এই ভুলটার জন্য শুভেচ্ছা জানালেন। কেন রে বাবা, এটা উনাকে না বলে আমাকে বললে কি আকাশ ভেঙ্গে পড়ত!
ইস্তারি সাহেবাকে কি ভাবে ম্যানেজ করলাম সে কাহিনী বলে অন্যদের বিরক্ত করার কোন মানে হয় না। সন্ধ্যায় শুধু একবার তিনি চিড়বিড় করে বলেছিলেন, ভাঁড় কোথাকার। কারণ অতি তুচ্ছ। আমি ১০ বছর আগের বিবাহের পোশাকটা পরেছিলাম। বরাবর যা পরি তাই পরেই বিবাহ করেছিলাম। সেই জিনস, সুতি শার্ট।
বিবাহের সময় কিছু অনায্য শর্ত ছিল আমার। পোশাক থাকবে এই। কন্যা ব্যবহারের কিছু কাপড় ছাড়া অন্য কিছু আনতে পারবে না। বরযাত্রী থাকবে সর্বসাকুল্যে ৭/ ৮ জন।
বিবাহের সময় মজার অনেক ঘটনার একটা ছিল এই রকম। আমি বসে আছি। কাজী সাহেব অনেকটা সময় বসে থেকে উসখুস করে বললেন, 'জামাই এখনও আইলো না, আমার তো আরেকটা বিয়া পড়াইতে হইব'।
একজন যখন আমাকে দেখিয়ে বললেন, 'জামাই তো আপনার সামনেই বসা'।
কাজী সাহেব সময় নিয়ে চশমা ঠিক করে ভাল করে আমাকে দেখলেন। টুঁ শব্দও করলেন না। কিন্তু তাঁর মনের ভাব বুঝতে আমায় বেগ পেতে হয়নি। তিনি যা ভাবছিলেন, এই বান্দর কোত্থিকা আমদানী হইল! আমি তাঁর দোষ ধরি না। পালিয়ে বিয়ে করলে এক কথা কিন্তু সেটেল ম্যারেজে একজন কাজীর এমনটা ভাবা বিচিত্র কিছু না।
আমার এই পাগলামির অন্য কোন কারণ ছিল না। আমার প্রবল আশা ছিল, আমার এই পাগলামি অন্য কোন একজন যুবকের মধ্যে সংক্রামিত হয় যদি। একটা অন্য রকম লোভ! লাভের লাভ হল কচু। ফাঁকতালে পাগল হিসাবে কুখ্যাতির পাল্লা ভারী হল। জোর গুজব, কারা কারা নাকি আমাকে দেখেছে ছাদে নাংগুপাংগু হয়ে আকাশের সঙ্গে কথা বলতে। এতে আকাশের কি এসে গেল জানি না তবে আমার দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয় বাতাস!
যাই হোক, দিনটা ভুলে যাওয়া কাজের কোন কাজ না। একটা খারাপ ভুল!
ইলেকট্রনিক পত্রাঘাত: ১
তবে এটা ঠিক আমি আমার পশুটার বিষয়ে সচেতন। যখন পশুটা বেরিয়ে আসে ভারী বিমর্ষ হয়ে যাই, নিজেকে তখন পোকা পোকা মনে হয়! নিজের চোখে চোখ রাখাই দায়! শোনেন, আমি জটিল কথা বুঝি না- বুঝি না আমার জ্ঞান বহির্ভূত কোন জ্ঞান। অল্প কথায় বুঝি, একজন মানুষ এই প্রকৃতিরই অংশ, জাঁক করে বলা চলে প্রকৃতির সন্তান। তো, একজন প্রকৃতির সন্তানের বিপুল ক্ষমতা। তার মতো করে অনায়াসে সাজিয়ে ফেলে প্রকৃতি এবং তার সহ-সন্তানদের।
দেখেন না, একজন পছন্দের মানুষ সামান্য একটু ছুঁয়ে দিলে আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়, কেন? এর কিছু রহস্য আমরা জানি, অনেকাংশই জানি না। আবার কেউ কেউ অনেকাংশটা জানেন, অন্যরা জানেন না।
প্রাসঙ্গিক বিধায় একটা প্রসঙ্গ শেয়ার করি। একজন মানুষ যখন মারা যাচ্ছিল তখন আমার হাত ধরে ছিল। আমার চোখের ভাষা বুঝতে ওই মানুষটার কষ্ট হয়নি। পান্ডুর হাসি দিয়ে বলছিল, আপনার হাতটা ধরে থাকলে আমার মরতে ভয় করবে না। ভাবুন কী হাস্যকর কথা! ট্রাস্ট মী, মানুষটা বিনা যন্ত্রণায় মারা গেল। তার বিশ্বাস তাকে নিয়ে খেলেছে, তার মৃত্যু যন্ত্রণা কমিয়ে দিয়েছে! এখানে আসলে আমার কোন ভূমিকাই নাই।
আসলে ভাল মানুষদের… কোন প্রয়োজনই হয় না। কারণ, এই প্রকৃতির, প্রকৃতির সন্তানদের তাকে বড়ো প্রয়োজন। আপনি তো এমনিতেই প্রকৃতির জন্য মমতায় মাখামাখি হয়ে আছেন। আপনার আলাদা করে ক্রাচের প্রয়োজন আছে কী, বাডি?
ধর্মহীনতা, ধর্মনিরেপেক্ষতা
আমার অল্প জ্ঞানে যা বুঝি, প্রথমেই আসতে হয় রাষ্ট্রের কথায়। রাষ্ট্র হচ্ছে পিতাসম। পিতার কাছে তার সব সন্তান যেন হাতের সবগুলো আঙ্গুল। এই আমার মত। এখন পিতার আচরণ তার সন্তানদের উপর কেমন হবে সেটা আঁচ করা মুশকিল। এমন হওয়া বিচিত্র কী! রাষ্ট্রপিতা তার সন্তানদের পুরোদস্তুর চকচকে যন্ত্র বানাতে চান।
ধরা যাক, কোন রাষ্ট্র চাচ্ছে প্লেটোর মত গ্রহণ করতে। যেমনটি প্লেটো তার ইউটোপিয়ায় বলছেন:
“জন্মের সময়ই সব শিশুকে তাদের পিতামাতার কাছ থেকে সরিয়ে নিতে হবে; কোনও পিতামাতা যেন জানতে না পারে কোনটা তার সন্তান, তেমনি কোন শিশুও যেন জানতে না পারে কোনটা তার বাবা মা। বিকলাঙ্গ শিশু বা নিম্নমানের পিতামাতার সন্তানদের সরিয়ে নেয়া হবে একটি রহস্যময় জায়গায়।
…তাদের জীবনে এমন কোন গল্প থাকবে না যেখানে ভালো মানুষরা কাঁদে, হাহাকার করে, এমন কি তাদের প্রিয়মানুষ, বন্ধুর মৃত্যুতেও”।
বেশ তো। কেউ যদি মনে করেন, তিনি এমন একটা রাষ্ট্র চান; সমস্যা তো নাই। ক্ষতি কী, কিন্তু চলমান একেকটা রোবট যখন একের সঙ্গে অন্যে ধাক্কা খাবে এর দায় কে নেবে? ওই জগতে কোন হাসি থাকবে না, কান্না থাকবে না। কোন শেকড় থাকবে না। শেকড়বিহীন গাছ। একটা অন্য ভুবন! সাজানো ভুবন!
রাষ্ট্রের উদাহরণ দিলাম এই জন্য, এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার সমস্ত ধর্মাবলম্বীকে সমান অধিকার দেয়া। নাগরিকের পছন্দ, অধিকার যদি হয় তার ধর্ম পালন- রাষ্ট্রের দায়িত্ব এটা নিশ্চিত করা। একটি রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে নিরাসক্তদৃষ্টিতে তার সন্তানদের সমান চোখে দেখা। তবে সংখ্যাগরিষ্টতা, এই শব্দটা যখন আমদানি হয় তখনই পক্ষপাতদুষ্টতা অবলীলায় চলে আসে- ধাওয়া করে ধর্মহীনতা। ধর্মের নামে চরম অন্যায় করার সুযোগ করে দেয়া।
ঈশ্বর ভাজা ভাজা হন মানুষের কড়াইয়ে, ধর্মের নামে। নইলে যতবার চেষ্টা করা হয়েছে ঈশ্বরকে জানার জন্য ততবার এদের জ্যান্ত পুঁতে, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে- এখনও হয়, পদ্ধতিটা বদলেছে এই যা!
আমরা এই উদাহরণ মনে রাখার চেষ্টা করি না- নামজের সময় হলে বিশপ এলচিঙ্গার স্টানবুর্গের প্রধান গির্জায় নামাজ পড়ে নেয়ার অনুরোধ জানালে উলেমা দল গির্জার বেদীর সামনে কাবার দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। অথবা বাবরী মসজিদ নিয়ে যখন ধুন্ধুমার কান্ড তখন বিসমিল্লা খাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলো তাঁর বক্তব্য। তিনি বলেন, ‘আমার জায়নামাজ বিছানোর জায়গা থাকলেই চলে’।
ধর্ম মানুষকে এটা শেখায় অন্য ধর্মকে হেয় করতে, এটা আমি বিশ্বাস করি না। একেকটা ধর্মের শক্তি আঁচ করা যায় অন্যের ধর্মমতের প্রতি শ্রদ্ধায়। উন্নত অনেক দেশের এমন সিদ্ধান্তের উদাহরণ আমরা বিস্মৃত হই, মাইক দিয়ে আযান দেয়ার বিষয়ে যখন আপত্তি উঠে তখন সিদ্ধান্ত হয়, গির্জার ঘন্টা যত ডেসিবল তত ডেসিবলে আযান দেয়া যাবে। যেমনটি কোন উপজাতি বিশ্বাস করে, সামান্য একটা পাথরের টুকরোকে ঈশ্বররূপে- আমি সত্যটা জানি, এটা পাথর ব্যতীত কিছুই না, কিন্তু আমার কী অধিকার জন্মায় এতে পদাঘাত করার?
যেটা ভলতেয়ার বলার চেষ্টা করেছেন ২ লাইনে:“আমি তোমার সঙ্গে একমত না, কিন্তু তোমার মত প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু লড়ব।”
ধর্ম কেন জরুরী। আমি মনে করি, একেকটা মানুষকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখে অসংখ্য শেকল। প্রথমেই আসে শেকড়ের শেকল। তার উত্তরসুরিরা। ঝপ করে আসমান থেকে তো কেউ আর পড়ে না- তার বাবা, মা আত্মার সম্পর্কের কেউ না কেউ তো থাকেই। শিক্ষার শেকল, ধর্মের শেকল- রাশি রাশি শেকল। এটা স্বীকার করে নিতে হয় ধর্মের শেকলে বেঁধে রাখাটা সহজ- এও সত্য, একজন ধর্মবক্তার কোন যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না!
একজন মানুষকে হরদম লড়ে যেতে হয় কুর সঙ্গে। এই লড়াইয়ে শেকলের যে বড়ো প্রয়োজন- হোক না সেটা ধর্মের শেকল। যার যে শেকলটা প্রয়োজন, চাপাচাপি করার তো কিছু নাই।
একজন স্বশিক্ষিত নাস্তিক, এটা তো তার সিদ্ধান্ত। সমস্যা দাঁড়ায় তখনি, যখন জোরজবরদস্তি শুরু হয়ে যায়। আমরা চট করে বলি, তুমি কি ধর্মীয় আচার পালান করো- কিন্তু এটা মনে রাখি না, তারও অধিকার দাঁড়ায় এ প্রশ্নটা করার কেন তুমি ধর্মীয় আচার পালন করো?
অন্য ভাবে দেখারও অবকাশ আছে। আমরা একটা মুভি নিয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা করি কিন্তু ফট করে বলে দেই আমি নাস্তিক। ৫টা মিনিট চোখ বন্ধ করে এই মহাবিশ্বটার কথা ভাবতে সচেষ্ট হই না। এখন তো শোনা যাচ্ছে প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা। ইউনির্ভাস ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। এর জন্য দায়ী যে শক্তি, বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ডার্ক এনার্জি। এই ডার্ক এনার্জি সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরা জানেন মাত্র ৪ ভাগ।
তো, আমি যেটা বলতে চাচ্ছিলাম, আমাদের কাছে যথেষ্ট জ্ঞান আছে, ফাইন। কিন্তু কতটা জ্ঞান, কবেকার জ্ঞান? অবস্থান, সময় খুব একটা বড়ো ফ্যাক্টর।
আরেকটা বিষয়, একজন নাস্তিকের এটাও সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ তাঁর মৃত্যুর পর মৃত্যু পরবর্তী আচার কি হবে? একজন নাস্তিকের মৃত্যুর পর তাঁর ভাষায় বিড়বিড় করে বিজাতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করার চেয়ে হাস্যকর আর কি হতে পারে!
এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, বৃটিশ শ্রমিক দলের নেতা বিভান ছিলেন নিরীশ্বরবাদী। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পর, বাইবেল পাঠ করা অর্থহীন। তো, বিভানের স্বরচিত গ্রন্থ In place of fear থেকে খানিকটা পাঠ করার জন্য।
*(আরও কিছু বিষয় যোগ করার আছে হয়তো পরে, হয়তো কখনও না।)
ভার্চুয়াল খাবার!
তো, এই মন্তব্যটা আমি হুবহু এখানে তুলে দিচ্ছিঃ “অ মামা, আমি পরশু রাত তিনটা তক গরুর মাংস রানছি, খাইবা। পরটা আমি বানাইতে পারি না, তয় মামা, সালাত বানাই ভাল, সরিষার তেল আর কাঁচা মরিচ দিয়া ডইলা। তুমি আমার জেনি রে একটু দেইখা রাইখো, মামা।···।”
আসলে এই জেনিকে তো আমি আর চিনি না- এর জন্ম আমার মস্তিষ্কেরর গোপন কুঠরিতে। এই ভার্চুয়াল খাবার, স্বাদ কী অতুলনীয় - গরুর মাংস, পরোটা···। আমি ভুলে যাব কিন্তু মস্তিষ্ক ঠিকই মনে রাখবে।
“কল্লোল চাপা কষ্ট নিয়ে চিঠিটা পড়ছে। ভাগ্নের চিঠি অস্ট্রেলিয়ায় আছে। তিন বছর হলো দেশে ফেরার নাম নেই। ওর মন অসম্ভব খারাপ হয়ে যায়। বিশ বছরের যে ছেলেটা পানি ঢেলে খেত না, ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটাচ্ছে পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবহীন, একাকী-নিঃসঙ্গ। কী কুৎসিত একটা জীবন! এ ছেলেটার কথা মনে হলেই বুক কেমন ভারি হয়ে উঠে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
মামা তোমাকে একটা মজার ঘটনা বলি, ওদিন তাড়াহুড়ো করে স্কুলে যাচ্ছি। ইলেকট্রিক ট্রেনের অটোম্যাটিক দরজা লেগে গেল। আমার স্ড়্গুল ব্যাগ বাইরে আমি সরু ফিতা ধরে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছি। যে স্টেশনে নামব এপাশের দরজা খুলল না, খুলল গিয়ে কয়েক স্টেশন পর। স্কুলে ম্যাডাম জানতে চাইলেন দেরি কেন হলো, আমি বুঝিয়ে বলছি। পুরোটা বলতে পারলাম না।
মামা জেনীটা না বড়ো ফাজিল। একদিন এমন ক্লান্তি লাগছিল টিফিন আওয়ারে চোখ লেগে গেল। ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলে দেখি টিফিন ব খালি। জেনী টিস্যুতে হাত মুছতে মুছতে হাসিমুখে বললঃ সরি, তোমার টিফিন আমি খেয়ে ফেলেছি, আমারটা তুমি খাও। ওর খাবার চিবুতে চিবুতে বিরক্ত হয়ে আমি বললামঃ জিনিসটা কি, রাবারের মতো মনে হচ্ছে! জেনী চোখ কপালে তুলে বললঃ কি বলছ, মার কি অসাধারণ রান্নার হাত। এতে কচ্ছপ কচি শুয়োরের মাংস সবই তো আছে।
আচ্ছা মামা, আমাদের ঐ টিয়াটা কি এখনো আছে ঐ যে ঠুকরে ঠুকরে রক্ত বের করে ফেলত। তুমি যে চিড়বিড় করে বলতে, বড় পাজি হইছে এইটা। তুমি শেষে লোহার খাঁচা বানিয়ে আনলে। ঐ টিয়াটাকে ভাল করে তাকিয়ে দেখো, দেখবে ওটা আমি। মামা, অ মামা, বড় কষ্ট’!”
স্বাধীনতা- বাদামের খোসা (!): ১
( দৈনিক পূর্বদেশ, ১৯ জানুযারী, ১৯৭২)
আলবদর সম্পর্কে দৈনিক সংগ্রাম, ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ এ লিখেছিল, “আলবদর একটি নাম। একটি বিস্ময়! আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা! যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী আলবদর সেখানেই। যেখানেই দুস্কৃতিকারী, আলবদর সেখানেই। ভারতীয় চর কিংবা দুস্কৃতিকারীদের কাছে আলবদর সাক্ষাৎ আজরাইল!”
(ড· মোহাম্মদ হান্নান)
(দৈনিক সংগ্রাম, ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)
“একদিন পাকিস্তানী আর্মি এক রাজাকারকে মেয়ে যোগাড় করে দিতে বলে। ওই রাজাকার অনেক খুঁজেও কোন মেয়ে যোগাড় করে দিতে ব্যর্থ হলে, পাকিস্তানী আর্মিরা রাজাকারকে বলে তার বাড়ীতে নিয়ে যেতে। রাজাকার সরল মনে পাকিস্তানী আর্মিদেরকে তার বাড়ীতে নিয়ে যায়। রাজাকারের বাড়ীতে গিয়েই আর্মিরা ভেতরে ঢুকে পড়ে- তারা দেখে রাজাকারের মা বসে আছেন। তারপরেই আর্মিরা বাইরে চলে আসে এবং রাজাকারের বুকে রাইফেল ধরে তার চোখের সামনে তার মাকে উপর্যুপরি, একে একে সবাই ধর্ষণ করে। এক সময় আর্মিরা তাদের ক্যাম্পে চলে যায়।
এ খবর ছড়িয়ে পড়ে। রাজাকারটি এরপর অজানার উদ্দেশ্যে হারিয়ে যায়- তার আর কোন খবর পাওয়া যায়নি।”
স্বাধীনতা- বাদামের খোসা (!)
…তারপর ঢুকলো অভ্যন্তরে। বাড়ীর ভেতর ঢুকে ঘর থেকে বের করলো ১০ বছর থেকে ৬০ বছর বযসের সব পুরুষকে। বাড়ির একজন বধু ও একজন মেয়েকে ধর্ষণ কররো তাদের স্বামী, মা বাবা, শ্বশুর শ্বাশুড়ির সামনে। এক পাক আর্মি ঘুমন্ত একটি বছর দেড়েকের বাচ্চার বুকে বেয়ানেট ঢুকিয়ে দিল। তারপর বেয়নেটের আগায় ঝুলিয়ে রাখলো বাচ্চাটার কচি দেহ। সেই অবুঝ শিশুর হাড় গোড়গুলো রক্ত বেয়ে পড়ছে পাক আর্মিটির হাতে ধরা রাইফেল থেকে।
…রাস্তায় লাশ আর লাশ- চোখে পড়লো জি পি ও’র পেছনে এক ঝুড়ি মানুষের রক্তাক্ত হৃদপিন্ড আর নাড়ি ভুঁড়ি!
…ড্রেনে রক্তের স্রোত, গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে!
…আমি তাকাতে চাই না- আমার মাথা কাজ করছিল না।
সূত্রঃ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ,অষ্টম খন্ড/ প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ-নাজিমুদ্দিন মানিক২৫শে মার্চ থেকে ২৭শে মার্চ)
আমরা কি আরও ৩৫ বছর অপেক্ষা করব?
কেন?
এর পেছনে অবশ্যই আছে নানা কাহিনী। এখানে সমাহিত করার পেছনেও আছে নানা কাহিনী।
বাংলাদেশের সর্ব কনিষ্ঠ বীরক্রিম হামিদুল হোসেন তারেক- এর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁর কাছ থেকেই জানলাম, মতিউর রহমানকে খানিকটা বাইরে সমাহিত না করা হলে একজনের সমাধিস্থলের গুরুত্ব নাকি কমে যাবে। বেশ, যা হোক। তো, ১ বছরেও আমরা মতিউর রহমানের এপিটাফ স্থাপন করতে পারিনি এখনও। এটাও ভাল, হয়তো আরও ৩৫ বছর লাগবে আমাদের এই মহা মহা জটিল কাজটা করতে। আমি ’ফ্রিডম’ বইটিতে মিলি রহমানের ২টি লেখা ব্যবহার করেছিলাম। প্রয়োজন মনে করায় আবারও এখানে দিচ্ছি।
———————–
মিলি রহমান একটি দৈনিকে মর্মস্পর্শী ভাষায় লিখেছিলেন: মতিউরের জন্য একটু জায়গা···
প্রতিটি মানুষেরই একটি ঠিকানা থাকে, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানেরও ছিল। ’৭০-’৭১ সালে সেই ঠিকানা ছিলঃ ১৯/২ অফিসার্স ফ্যামিলি কোয়ার্টার, মসরুর বেস, করাচি, পশ্চিম পাকিস্তান। এখনো মতিউর রহমানের একটা ঠিকানা আছেঃ চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থান, মসরুর বেস, করাচি, পাকিস্তান। শুধু ঘর বদলেছে আর বদলেছে নম্বর। তবে আগে ঘরটি ছিল মাটির ওপর, এখন মাটির নিচে। নতুন ঘরের নম্বর আমার জানা নেই, আর কেউ জানে কি না তাও জানি না।
ভালবাসার মানুষটির জীবনের বিনিময়ে আমার কিন্তু একটা নতুন ঠিকানা হয়েছে। আমি এখন বাংলাদেশী। ‘৭১-এর ২৯ সেপ্টেম্বর ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে বোনের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে ভালোবাসার মানুষটিকে ভিনদেশে ফেলে বাংলাদেশে চলে আসি।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। মতিউরের ত্যাগের স্বীকৃতিস্বরুপ তাকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হলো। কিন্তু কেউ তার ঠিকানা বদলাতে সচেষ্ট হলো না। আমরা সবাই বাংলার মাটিতে নতুন করে ঘর বাঁধলাম, কিন্ত আমার মতির জন্য এতটুকু জায়গা পাওয়া গেল না। আমি কিন্তু এখনো ভোর বেলা হাঁটতে গিয়ে বকুলতলা থেকে দুহাত ভরে ফুল কুড়িয়ে আনতে পারি, শোবার ঘরের জানালা দিয়ে দেখতে পারি শিউলিতলায় ছড়িয়ে থাকা ফুল, শুনতে পারি বাড়ির ছাদে পোষা পায়রার বাকবাকুম।
···আমি এক অক্ষম স্ত্রী। ৩৩ বছরেও আমার মতির ঠিকানাটা আমি বদলাতে পারিনি।
···২০০৩ সালের ৩১ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ভিত্তি স্থাপন করা হয় শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্মৃতিসৌধ। ভিত্তি স্থাপন করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী রেদওয়ান আহমেদ চৌধুরী। সেদিন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের কবর স্থানান্তরিত করার কথা উঠলে এমন কথাও বলা হয় যে, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরও তো চট্টগ্রাম থেকে উঠিয়ে ঢাকায় এনে দাফন করা হয়েছিল।
কদিন আগে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতকে ইসরায়েলের প্রবল বাধার কারণে তার প্রিয় শহর জেরুজালেমের পরিবর্তে রামাল্লায় দাফন করা হয়। ফিলিস্তিনিরা স্বপ্ন দেখছে তাদের প্রিয় নেতার কবর একদিন জেরুজালেমে স্থানান্তরিত করার। সে জন্য তাকে পাথরের কফিনে সমাহিত করা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, কবর স্থানান্তরিত করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বাঁধা নেই। সার্ক দেশভূক্ত পাকিস্তানেরও কোনো আপত্তি থাকার কথা না···।
আপনি মরে বেঁচে গেলেন, আমাদেরকে বাঁচিয়ে
এমনই একজন মুক্তিযোদ্ধা সুরুজ মিয়া। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়লগ্নে তিনি কি ভাবছিলেন? অন্য ভুবনের আনন্দ? সুরুজ মিয়ারা সেলিব্রেটি তো নন, যে আমরা এইসব মুখস্ত করে বসে থাকব!
আচ্ছা, ২০০৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোরে এই মানুষটাই দুম করে গলায় ফাঁস লাগিয়ে যখন ঝুলে পড়লেন তখনই বা কি ভাবছিলেন? এটাও কখনও জানা হবে না।
জীবনান্দ দাশের মানুষটার মরিবার সাধ আমি আজও বুঝিনি কিন্তু এই মানুষটা মরিবার কেন হলো সাধ, এটা খানিকটা বোধগম্য হয়। সুরুজ মিয়া মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলেন নিশ্চই। দারিদ্র, দীর্ঘ রোগভোগ, টাকার অভাবে সুচিকিৎসায় ব্যর্থতা, সরকারের দেয়া মুক্তিযুদ্ধ ভাতা বন্ধ হয়ে যাওয়া।
মানুষটা রাতের পর রাত পেটের অসহনীয় ব্যথায় জবাই করা পশুর মত চিৎকার করেছেন। সুচিকিৎসা হয়নি! সব মিলিয়ে ৩৫তম বিজয় দিবস এই মানুষটা কাছে কোন অর্থই বহন করেনি। সমস্ত জাতি যখন প্রস্থত হচ্ছিল বিজয় দিবস পালন করার জন্য- মানুষটা দুর্দান্ত অভিমানে চলে গেলেন। ভোরের মোলায়েম সূর্যটা মোটেও আকর্ষণীয় মনে হয়নি তাঁর কাছে।
প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছিল (এটা জানা গিয়েছিল প্রথম আলোর রিপোর্টে), তিনি যেহেতু আত্মহত্যা করেছেন, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর দাফন হবে না। মানুষটার লাশ ১২ ঘন্টা গাছে ঝুলছিল।
আমাকে যেটা বিস্মিত করেছিল, হতভম্ব করেছিল , রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর দাফন নিয়ে সংশয়ের বিষয়টি। এই সংশয় পোকাটির উৎস কোথায়- কোন নিতল থেকে উঠে আসে এমন ভাবনা। যারা এমনটা ভাবে, তাঁদের এই ভাবনার উৎস কী!
ওই প্রজন্মই তো আজ কেউ ইউএনও হচ্ছে, সরকারি বড় কর্তা হচ্ছে। দেশের মাথায় বসে বনবন করে ছড়ি ঘোরাচ্ছে- এদের শিক্ষাটাই এসেছে এমন করে।
আমাদের দেশে ব্রেভহার্টের মতো একটা মুভি কখনই হবে না। এ দেশে সুরুজ মিয়া, ১০ বছরের বালক লালু বা অপারেশন জ্যাকপট নিয়ে কোন ডকুমেন্টারী কখখনই বানানো হবে না। আমাদের মহান নাট্যনির্মাতারা জাঁক করে বলবেন, এ দেশে ভাল স্ত্রিপ্ট কোথায়! তো, চলো ভারত থেকে আমদানী করি। খোদা না খাস্তা, কেউ বানালেও, চলবে না- ছ্যা, এইসব বস্তাপচা জিনিস আবার মানুষ দেখে!
আমি নিজেকেই দিয়েই একটা উদাহরণ দেই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কলমবাজি করার চেষ্টা করি। অথচ মতিউর রহমানকে নিয়ে মুভি বানানো হয়েছে, সিনেপ্লেক্সে চলেছে, মিলি রহমান এসেছেন। কসম, এটা আমার জানা ছিল না। শমোচৌ বলায় জানলাম (তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা)। তো, কেন যেন মনে হচ্ছে আমরা কি ভুল রাস্তায় হাঁটছি। আমরা কী অবলীলায় আমাদের মায়ের গায়ের গন্ধটা ভুলে যেতে চাইছি। কে জানে, হবে হয়তো বা!