Search

Saturday, May 30, 2015

শ্রদ্ধাস্পদেষু শামসুল হক।

আমি এক লেখায় লিখেছিলাম, “সৈয়দ শামসুল হকের চিবিয়ে চিবিয়ে বলার ভঙ্গি রপ্ত করাটা চাট্টিখানি কথা না! তাই তাঁর এই বলার ভঙ্গির আমি ফিদা!...”
ফিদা কেবল এই কারণেই না। এমনিতে আমাদের এই সৈয়দ সাহেব বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপাধি বিলি করে বেড়ান কখনও ‘ভাষাকন্যা’ তো কখনও ‘দেশরত্ম’। আফসোস, অথচ এই ভদ্রলোককে কোনও প্রকারের উপাধি দেওয়ার সুযোগ আমাদের নাই। কী অভাগা আমরা এই প্রজন্ম!

সৈয়দ সাহেবের জন্য কোনো প্রকারের উপাধি আসলে নস্যি। কারণ ইনি এক বিরল প্রতিভা! অন্য গ্রহের কথা জানি না অন্তত এই গ্রহে তিনি ব্যতীত এমন প্রতিভার জন্ম হয়েছে এমনটা অন্তত আমি বিশ্বাস করি না। তিনি যে ভঙ্গির উপর ভর দিয়ে ক্যালিগ্রাম বা কবিতা-চিত্র লিখেছিলেন ১৯৯৩ সালে, সেই ভঙ্গির কবিতাই ১৯১৮ সালে লিখেছিলেন Guillaume Apollinaire নামের এক ভাবচোর [১]!

ওহে Guillaume Apollinaire, ব্যাটা ফিরিঙ্গি, পাজি, নচ্ছার সৈয়দ সাহেবের ভাব চুরি করে কিনা কবিতা ফেঁদে বসল! অথচ সৈয়দ সাহেব তখনও এই ভুবনে পদার্পণ করেননি, জন্মও হয়নি বিধায় এর প্রতিবাদ জানাবার সুযোগ তাঁর ছিল না। কিন্তু আমরা এই প্রজন্ম এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি Guillaume Apollinaire-এর কালো হাত ভেঙ্গে দাও, দিতে হবে।

সৈয়দ হকদের মত বিরল প্রতিভা যে কেবল দু-হাতে লেখালেখি করেন এমনই না তেলের খনিতে [২] দু-হাতে সাঁতারও কাটেন। বাংলাদেশের সমুদ্রজয়ে অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে গণসংবর্ধনা দেওয়ার জন্য না কেবল প্রস্তুতির জন্য নাগরিক কমিটির পক্ষে ৫০১ জনের যে পরামর্শক মহোদয়গণ উপস্থিত ছিলেন, এদের মধ্যে আমাদের সৈয়দ সাহেবও একজন!

সহায়ক সূত্র:
১. প্রতিভাবান: http://www.ali-mahmed.com/2011/08/blog-post_18.html
২. তেলের খনি: http://www.ali-mahmed.com/2012/04/blog-post.html

Thursday, May 28, 2015

পশুর জন্য কেবল জঙ্গলের আইন!

('বাংলার বান কি মুন' এবং শিশুদের এই লেখাটা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার পরামর্শ।)
এর নাম রাজু। একে নিয়ে বেশ কিছু লেখা আছে আমার। শেষ লেখাটা লিখেছিলাম, দুপেয়ে পশু [১]। ওই লেখাটায় লিখেছিলাম, এক পশু রাজুর দুই হাতই ভেঙ্গে দিয়েছিল। প্রয়োজনের সময় রাজুর নাগাল পাওয়া প্রায় অসম্ভব বিধায় তার হাতের হাড় জোড়া নিয়েছিল বাঁকা হয়ে। কপাল, কিছুই করার নেই! আমার মত যে নপুংশক, যেপর্যন্ত না শিশুদের জন্য আশ্রম করতে পারবে সেপর্যন্ত সে তাকিয়ে তাকিয়ে এই সব দৃশ্য দেখবে, একের-পর-এক।
এর ঘুমাবার ভঙ্গি বড়ো বিচিত্র। স্কুলে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। কী ঘুম!
আমার নিজস্ব জটিলতার কারণে স্কুলে নিয়মিত যাওয়া হচ্ছিল না। স্কুলে পড়ায় যে মাস্টার, আলী আজ্জম অপু আমাকে ফোন করেই বলে, স্কুলে আসেন, তাড়াতাড়ি।
আমি খানিকটা বিরক্তি চেপে বলি, কেন কী হয়েছে?
তার তাড়া, আসেন, তাড়াতাড়ি।
আমি স্কুলে গিয়ে দেখি রাজুর গালে বিভৎস দাগ। অনেকটা শুকিয়ে গেছে তারপরও নমুনা দেখে আমি হতভম্ব। আমি রাজুর কাছে জানতে চাইলাম, তোমার গালে কি হইছে?
রাজু বলে, যেই বেডা আমার হাত ভাইঙ্গা দিছিল হে গালে কামড় দিছে।
আমি খানিকটা থমকে যাই। কারণ আমার ধারণা ছিল যে রাজুর হাত ভেঙ্গে দিয়েছিল তার কোনও হদিস পাওয়া যাবে না কারণ রাজু গুছিয়ে বলতে পারেনি কে তার হাত ভেঙ্গেছিল। আমি উত্তেজনা চেপে রাখি, শেষপর্যন্ত কী লোকটার সন্ধান পাওয়া যাবে?

আমি বলি, তুমি কি এই লোককে চেন?
রাজু খেলা থামিয়ে বলে, হ, চিনি তো। হের নাম জাইঙ্গা। হে আমার হাতের নখও তুইলা লাইছে।
আমি বুঝতে পারি এর নাম জাহাঙ্গির। আমার ভেতরে অজানা এক দ্রোহ পাক খায়। অজান্তেই শ্বাস দ্রুত হয়। খানিকটা সামলে নিয়ে বললাম, তুমি কি এই জাহাঙ্গিরকে চিনিয়ে দিতে পারবে?
রাজু ভয়পাওয়া গলায় বলল, পারুম না। হে আমারে মাইরা লাইব। আমি রাজুকে আশ্বস্ত করি, ভয় নাই। তুমি দূর থিক্যা আমারে দেখায়া দিবা। পারবা না?
রাজুকে কোনওপ্রকারেই রাজী করানো গেল না। সে ভয়ে আধমরা হয়ে আছে। এরপর এই শিশুটির প্রতি অন্যায় চাপাচাপি করতে মন সায় দিল না।

স্টেশনে আমি এবং মাস্টার অপু চক্কর লাগাই। পাওয়া গেল রাজুর মাকে। রাজুর মাকে বললাম, আপনি কি জানেন আপনার ছেলের হাত কে ভেঙ্গেছে?
আগের লেখায় বলেছিলাম রাজুর বাবা নেই এবং রাজুর মা খানিকটা অপ্রকৃতস্থ- স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। তিনি বললেন, হ, জানি তো। জাহাঙ্গিরা রাজুর হাত ভাঙ্গছে। হেরে ডরে কেউ কিছু কয় না।
আমি আশার আলো দেখি। বলি, আপনি কি দূর থেকে জাহাঙ্গিরকে চিনিয়ে দিতে পারবেন? তিনি কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে এই মানুষটাকে চিনিয়ে দেন।
আমি কাছে গিয়ে জাহাঙ্গির নামের এই মানুষটাকে বললাম, তোমার নাম জাহাঙ্গির?
সে হেলাফেলা করে বলল, হ। ক্যান, হি হইছে?
আমি দুর্দান্ত রাগ চেপে বললাম, এখনও কিছু হয় নাই, তবে হবে। তুমি রাজুর হাত ভেঙ্গে দিয়েছ কেন? আবার এর গালে কামড়ও দিয়েছে, কেন? নখ তুলে ফেলেছ!
জাহাঙ্গির আমাকে বলল, তো আপনের কি হইছে, হে আপনের কিছু লাগে?

বলা হয়ে থাকে, যে হাত দিয়ে লেখক লেখে সে হাত নাকি অন্য কোনো কাজে লাগে না। কথাটা রূপকঅর্থে বলা। মোদ্দা কথা, ওই হাত কেবলই লেখালেখির জন্য। কথা হচ্ছে ডান হাত নিয়ে। বাম হাতের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। তো, বাম হাত যদি চোখের পলকে উঠানামা করে তাহলে সমস্যা কোথায়?

ক্রমশ ভীড় জমে যায়। একজন কসম কেটে বলেন, তিনি নিজের চোখে দেখেছেন এই জাহাঙ্গিরকে যে চলন্ত ট্রেন থেকে রাজুকে ফেলে দিয়েছিল। চোর ব্যাটা আমার ছবি তোলার সমস্ত উপকরণ নিয়ে গেছে বটে কিন্তু মাস্টার অপুরটা তো বর্তমান। মাস্টার অপু তার সেলফোনে তোলা রাজুর ছবিগুলো গোল হয়ে দাড়িয়ে থাকা জনতাকে দেখাতে থাকে। জনতা কখন যে পুরো বিষয়টা আমার হাত থেকে আলগোছে সরিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছে আমি ঠিক জানি না।

একজন নাদুননুদুস টাইপের মানুষ ‘তবে রে’ বলে জো ফ্রেজিয়ার পাঞ্চ কষিয়ে নিজের হাতই মচকে ফেললেন। পরে এই মানুষটাকেই আমি দেখেছি স্লিং ঝুলিয়ে চলাফেরা করতে। অন্য একজন কোমরের বেল্ট খুলে (এই দৃশ্য পুরনো সময়কার মারকুটে সিনেমায় দেখা যেত। এখনকার সিনেমায় এই দৃশ্য অচল) যে ভঙ্গিতে পেটাতে লাগলেন তা দেখাটা সুখকর না। আমি আস্তে করে এই বৃত্ত থেকে সরে আসি। এখানে এখন আর আমার কোনও কাজ নাই। এই নিয়ে আমার মধ্যে কোনও প্রকারের অপরাধ বোধ কাজ করে না। কারণ মানবের আইন পশুর জন্য না- জঙ্গলে চলে জঙ্গলের আইন।

সময় গড়ায়। বৃত্তের ভেতরের উত্তাপ সীমা ছাড়িয়ে যায়। আমি ভেবে দেখলাম, এই পশুটাকে মেরে ফেললে তো আরেক ঝামেলা হয়ে যাবে। কিন্তু এখন এই বৃত্তের ব্যূহ ভেদ করা প্রায় অসাধ্য। আমি সেই অসাধ্য কাজটাই করলাম। জাহাঙ্গিরকে রেলপুলিশের কাছে সোপর্দ করা হলো। জনতা আমার উপর ভারী রুষ্ট। তাদের কথা, পুলিশ একে ছেড়ে দেবে।

মাত্র দুদিন পরই শুনলাম। জাহাঙ্গির ফিরে এসেছে। এবং রাজু ভয়ে কোথায় পালিয়েছে এর খোঁজ কেউ জানে না, তার মা-ও না! বিচিত্র কারণে জাহাঙ্গিরের সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছে না অথচ দেখা হওয়াটা জরুরি...।

সহায়ক সূত্র:
১‌. দুপেয়ে পশু: http://www.ali-mahmed.com/2015/03/blog-post_27.html 

*এই লেখার সবগুলো ছবিই মাস্টার আলী আজ্জম অপুর তোলা।

Monday, May 25, 2015

দুখু মিয়া-‘সুখু মিয়া’!

কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা ‘দুখু মিয়া’ নামেও চিনি। তিনি কেবল দুখি মানুষই ছিলেন না তাঁর গোটা পরিবারই ‘দুখি পরিবার’। আমি তো বলব, ‘অভাগা পরিবার’। যাদেরকে অহরহ এটা জানতে-শুনতে-পড়তে হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু হয়েছে সিফিলিসে? কেবল দিনের-পর-দিনই না বছরের-পর-বছর যুগের-পর-যুগ ধরে এই অপবাদ বয়ে বেড়াতে হয়েছে গোটা পরিবারকে।
অথচ এটা ছিল নিরেট মিথ্যা! এখনও, আজও আমি অজস্র লেখায় এটা পাই এই মিথ্যাচার নিয়ে []।  এখানে বিশদ লিখেছি। নজরুল নিউরো সিফিলিসে ভুগছিলেন না, ভুগছিলেন Pick's disease তাঁর চিকিৎসা হয় ভিয়েনায়, ড. হফের তত্ত্বাবধায়নে। এখন এই লেখায় আর চর্বিতচর্বণ করি না।
তিনি কেবল দুখু মিয়াই ছিলেন না, সুখু মিয়াও ছিলেন। কেমন করে? বলছি...।

তিনি যখন বাবরি চুল দুলিয়ে এই এই গান লিখলেন:
"...খোদারও প্রেমের শরাব পিয়ে, বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে...।"
ক্কী-ক-কী, কয় কী! খোদার প্রেমের সঙ্গে শরাব! কিন্তু তখন কারও চাকু-চাপাতির কোপে তাঁর বাবরি চুল লুটিয়ে পড়েনি।

যখন নজরুল লিখেলেন:
“...দোযখ আমার হারাম হ'ল পিয়ে কোরানের শিরীন শহদ।...” 
(খোদার বন্ধু /কাজী নজরুল ইসলাম।)
বলে কী- ‘কোরানের শিরীন শহদ’! মধু না বিষ সে পরের কথা কিন্তু কোরানের সঙ্গে তুলনা! তখনও কিন্তু নজরুলের বাবরি চুল গড়াগড়ি খায়নি! বুদ্ধিমান পাঠকের জন্য বাবরি চুলের সঙ্গে যে নজরুলের গোটা মাথাটাও যে গড়িয়ে পড়ত এটা আর উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করলাম না।

আর যখন লিখলেন এটা:
“...খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া, উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!...
...তাজী বোর্‌রাক্ আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!...
...আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন! আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!..."
(বিদ্রোহী/ কাজী নজরুল ইসলাম।)
কাট মাই...! বলে কী, ভগবানের বুকে...! তখনও কিন্তু খোদাভক্ত কেউ ‘কোপা সামসু’ বলে কোপায়নি বা ভগবানভক্ত কেউ ‘কোপা শংকর’ বলে ভোজালি দিয়ে নজরুলকে ফালা-ফালা করেনি!  অবশ্য তখন অনেকে নজরুলকে ‘লোকটা শয়তান না মুসলমান?' বা 'ইসলাম বৈরী মুসলমান কবি', 'ধর্মজ্ঞানশূন্য বর্বর' 'কুলাঙ্গার', ‘কাফের', 'ফেরাউন', 'নমরুদ', 'খোদাদ্রোহী', 'ধর্মদ্রোহী', ইত্যাদি সম্বোধনে সম্বধন করতে ছাড়েনি। কিন্তু নজরুলের বাবড়ি, বাবড়ির সঙ্গে মুন্ডুর কোন সমস্যা হয়নি। স্বস্থানেই ছিল।

আবার কিন্তু অনেকে লেখার উত্তর লেখা দিয়ে দিতেও ভুল করেননি। সজনীকান্ত দাস শনিবারের চিঠিতে ‘গাজী আব্বাস বিটকেল', 'ভবকুমার প্রধান' নামে লিখতেন। সজনীকান্ত দাস নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতাটির জবাবে একটি ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছিলেন, 'ব্যাঙ'।
আমি ব্যাঙ
লম্বা আমার ঠ্যাঙ
ভৈরব রভসে বরষা আসিলে ডাকি সে
গ্যাঙোর গ্যাঙ
আমি ব্যাঙ
দুইটি মাত্র ঠ্যাঙ...।
আমাদের বাপ-দাদাদের চেয়েও আমরা যে এখন অনেক বড় মুসলমান- দা থেকে আছাড় বড়! সুখু মিয়ার ভাগ্য-সুখ দেখে ঈর্ষা-ঈর্ষা! ভাগ্যিস, নজরুল আজ আর বেঁচে নেই- ঠিক সময় মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন! নইলে হাওয়ায় কেবল তাঁর বাবরি চুলই উড়ে বেড়াত না সঙ্গে কাটা মুন্ডুটাও...।

সহায়ক সূত্র:
১. কবি নজরুল সিফিলিসে আক্রান্ত, এই বিষয়ক মূর্খতা: http://www.ali-mahmed.com/2010/10/blog-post_21.html)। 

Wednesday, May 20, 2015

‘অস্ত্র করা’ ওরফে অপারেশন...।

আমার চোখে একটা অপারেশন করার প্রয়োজন দেখা দিল। অপারেশনের পূর্বে আমি হালকা চালের একটা লেখা লিখেছিলাম, “...'আবার আসিব ফিরে'। এই অপারেশনে কারও মৃত্যু হয়েছে এমনটা শুনিনি। আমার বেলায় এটা ঘটলে সেটা হবে বিরল ঘটনা!... তবে এই অপারেশনে অন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটাও তোপ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। অবশ্য এও সত্য, একজন লেখকের জন্য অন্ধ হয়ে যাওয়াটা মৃত্যুসম। তখন বাঁচা না-বাঁচা সমান...।”
এই লেখাটা যে আমার জন্য ভারী হয়ে দেখা দিতে পারে সেটা তখন বুঝিনি!

ডাক্তার সাহেব বিভিন্ন 'আক্কাড়-পাক্কাড়’, নাট-বল্টুর সহায়তায় আমার চোখ দেখে বললেন, একি অবস্থা! আপনার তো দু-চোখেই অপারেশন লাগবে।
আমি বললাম, জরুরি কোনটা?
ডাক্তার বললেন, দুই-ই সমান। দুইটাই করাতে হবে।
এই বাণীর জন্য আমি ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না। সামলে নিয়ে বললাম, কোনটা করানোটা প্রয়োজন...? আপাতত একটাই করাই...।
উঁহু, আপনাকে দুইটা চোখই করাতে হবে।
ডাক্তার সাহেব এই কথাটাই বেশ ক-বার বলার পর এবং যখন উষ্মা নিয়ে বললেন, আচ্ছা, আপনার সমস্যাটা কী বলুন তো!
ডাক্তারকে কে বোঝাবে যে আমি টাকা ছাপাবার মেশিন নিয়ে ঘুরে বেড়াই না, এটা আমার কাজ না- এই কাজটা আতিউর রহমানের। আমিও গম্ভীর হয়ে বললাম, আপনি কী একটা চোখ ফ্রিতে করে দেবেন?
যেসব ডাক্তারের নামের সঙ্গে এবিসিডিএক্সওয়াইজেড এন্তার ডিগ্রি থাকে তাদের সঙ্গে এমন করে বলার নিয়ম নাই। বলা তো শেষ, কপাল! তাছাড়া যে ডাক্তারের ছুরি-ছুঁচের নীচে আমাকে শুতে হবে তাকে ক্ষেপিয়ে দেওয়াটাও মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ না। হয়তো দেখা গেল ডাক্তার সাহেব আমার একটা চোখ তুলে চিমটা দিয়ে ধরে অন্য চোখের সামনে এনে বললেন, ছিঃ, কী ময়লা! এই কে আছিস, শিরীষ কাগজ নিয়ে এটাকে ঘষে পরিষ্কার কর। আর শোন, ব্লিচিং পাউডারে ডুবিয়ে রাখতে ভুলবি না কিন্তু।
আহা, এমনটা করলে আটকাচ্ছে কে!

ডাক্তার সাহেবের রেগে যাওয়ার কথা কিন্তু তিনি রাগ না-করে হাসি-হাসি মুখে বললেন, আচ্ছা, তা কোনটা করাবেন?
আমি হড়বড় করে বললাম, বাম চোখটাই করাই। (দুইটার মধ্যে বেছে নিলে হলে বামটাই সই। বললে বলল লোকজন নাহয়, ‘এক চোখ কানা বুইদ্দার...’।)
এবার ডাক্তার হাসি গোপন করে বললেন, করাতে পারেন। কিন্তু...।
আমি চিড়বিড় করে বললাম, কোনও কিন্তু-টিন্তু নাই। এইটাই ফাইনাল।
ডাক্তার বললেন, আচ্ছা, অপারেশনের পনেরো দিন পর মনে করে চোখটা দেখিয়ে যাবেন।

এখানে দেখি কেবল ডাক্তার না নার্স-টার্স সবাই খুব মাই ডিয়ার টাইপের। ওয়াল্লা, অপারেশনের পূর্বে কেবল আগুনগরম কফিই দিয়ে গেল না সঙ্গে কুকিজও! আমি বিছানায় শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে কফিতে চুমুক দিচ্ছি। ডাক্তার নিয়ম ভেঙ্গে এখানে চলে এসে যেটা বললেন তা শুনে আমার গা হিম হয়ে এলো।
ডাক্তার কষ্টার্জিত গম্ভীর হয়ে বললেন, দেখুন, আপনাকে জানানোটা প্রয়োজন মনে করছি। আপনার হাই মায়োপিয়া। অপারেশনে আপনি কিন্তু ঝুঁকিতে আছেন। ট্রাই মাই বেস্ট, বাকীটা আল্লাহ ভরসা। কি, ভয় করছে?

আমি ভয় চেপে বললাম, না, বলে ভাল করেছেন। তথ্য পাওয়াটা আমার অধিকার। আর অপারেশনটা করবেন আপনি। আপনি ভয় না-পেলেই আমার জন্য মঙ্গল। ইয়ে, আপনারা দেখি রোগির জন্য ভালই খাওয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন। এমনিতে রোগির চেয়ে কিন্তু ডাক্তারের জন্য এটা জরুরি। ক্ষুধার্ত সার্জনের ছুরির নীচে শুতে নেই।
ডাক্তার এবার হা হা করে হাসতে হাসতে বললেন, ভাল-ভাল, আপনি ট্রিকটা ধরে ফেলেছেন দেখি! রোগি স্বাভাবিক থাকলে আমাদের জন্য সুবিধা। আমাদেরকে মাইক্রোসকোপের নীচে কাজ করতে হয়। রোগি ভয় পেয়ে চোখের মনি বনবন করে ঘুরতে থাকলে বড়ো মুশকিল হয়ে যায়, বুঝলেন। পাঁচ মিনিট পর ওটিতে আসেন, কাজটা সেরে ফেলি।

ভাল ভাবেই অপারেশনটা শেষ হলো। মহাআনন্দে আমি বুড়া বাড়িটার কাছে ফিরে এলাম। কিন্তু দু-চোখে দুই রকম দেখি। কী যন্ত্রণা! পনেরো দিন দুঃসহ সময়টা পার করাটা আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ল। পনেরো দিন পর ডাক্তারকে যখন বললাম, অন্য চোখটাও অপারেশন করে ফেলেন তখন ডাক্তার মুখ ভরে হেসে বললেন, কী বলেছিলাম না...।

Sunday, May 17, 2015

হাজার-হাজার ‘টার্মিনাল’!

অনেক বছর পূর্বে অসাধারণ একটা মুভি দেখেছিলাম ‘The Terminal’। আমার দুর্বল স্মৃতিশক্তির কারণে আজ আর তেমন বিশেষ কিছুই মনে নাই কিন্তু সেই মানুষটার কিছু অনুভূতি এখনও আমি স্পর্শ করতে পারি, অম্লান।
সেই মানুষটার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সম্ভবত টম হ্যাংকস। এই ‘ম্লেচ্ছ ব্যাটা’ ব্যতীত এমন একটা মানুষের ভূমিকায় এমন দুর্ধর্ষ অভিনয় করা সম্ভব না। এয়ারপোর্টে আটকাপড়া সেই মানুষটা, যে হঠাৎ করেই শুনতে পায় রাজনৈতিক জটিলতার কারণে তার দেশ বলে আর কিছু নাই! এক পয়সার মূল্য নাই তার সঙ্গে থাকা ভিসা-পাসপোর্ট-মুদ্রার।

সেই মানুষটা উদভ্রান্ত সেই চোখের দৃষ্টি আমাকে তাড়া করে, আজও! একটা মানুষ এমনঅবস্থায় আটকা পড়ে আছে ভিনদেশের এক এয়ারপোর্টে দিনের-পর-দিন! এই ‘সুন্দর-করুণ’ অনুভূতিটা আসলে কেবল স্পর্শই করা চলে, আমার মত মানুষের লিখে বোঝাবার ক্ষমতা কই!

তবুও ওই মানুষটার খাবার ছিল, মাথার উপর নিরাপদ ছাদ ছিল। ভাষা না-জানুক অন্তত বডি ল্যাংগুয়েজ দিয়ে অন্যদেরকে বোঝাবার চেষ্টা ছিল কিন্তু এখন আন্দামান-মালাক্কায় যে হাজার-হাজার মানুষ সমুদ্রে ভাসছে তাদের অনেকের মাথায় উপর সূর্য নেমে এসেছে, খাবার নেই, চারপাশে বিপুল জলরাশি অথচ এক ফোঁটা খাওয়ার পানিও নেই।
এঁরা ভাসছে কেবল দিনের-পর-দিনই না মাসের-পর-মাস ধরে। রাজনৈতিক জটিলতার কারণে এদের এখন কোনও দেশ নেই। কূলে পৌঁছামাত্র কোনও দেশ ইঞ্জিন বিকল করে ভাসিয়ে দিচ্ছে তো কোনও দেশ ইঞ্জিন ঠিক করে দিয়ে কিন্তু কোনও দেশই এদেরকে নিতে চাচ্ছে
না।

আজ জানলাম, খাবারের জন্য নাকি এরা খুনাখুনি করছেন! যদি এটা শুনি, একজন অন্যজনের মাংস খাচ্ছে এতে অন্তত আমি মোটেও অবাক হবো না।
এঁদের অসহ্য বেদনা-অনুভূতি আমি খানিকটা বুঝতে পারি এই মিথ্যাচার করার কোনও অর্থ হয় না। অন্তত নিজের সঙ্গে এই কপটতা করার চেষ্টা করি না...।