Search

Saturday, March 23, 2013

টর্ণেডো, জীবন-মৃত্যু, মমতা এবং ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প!

গতকাল যে টর্নেডো বয়ে গেল, আমি যেখানে থাকি এটা এর এতো কাছ থেকে গেছে যেটা টর্নেডোর জন্য কেবল চোখের পলক। যেন মাথার চুল ছুঁয়ে যাওয়া। আমাদের এতো কাছে অথচ আমরা এখান থেকে টেরটিও পাইনি। একজন এক সুহৃদ যখন ফোন করে কাঁদছিল তখনও আমি বুঝিনি এর ভয়াবহতা। আমরা আবেগপ্রবণ জাতি, অল্পতেই কান্না চলে আসে তখনও আমি তার কান্নাকে ততোটা ­গুরুত্ব দেইনি।

কিন্তু আমাদের স্বাস্হ্য-কমপ্লেক্সে যখন স্রোতের মত ঠেলাভ্যান-স্কুটার-ট্রাকটর-ট্রাকে করে শত-শত আহত লোকজন আসা শুরু করলেন সেই দৃশ্যের বর্ণনা দেয়া অসম্ভব। মানুষের এমন আহাজারি নিজের চোখে না-দেখলে বোঝানো মুশকিল।

আমার বুক ভেঙ্গে আসছিল কেবল এটা ভেবে, এরা কী আশা নিয়েই না আসছেন, বাঁচার কী তীব্র আকুতি নিয়েই না আসছেন হাসপাতালে। কিন্তু আমি জানি, এই হাসপাতালের এই ক্ষমতা নাই এই স্রোতের মত আসা মানুষগুলোর চিকিৎসা দেয়ার। আমি নিশ্চিত, ১০জন ডাক্তার থাকার কথা কিন্তু এখন দুয়েকজন ব্যতীত কোনো ডাক্তার পাএয়া যাবে না হাসপাতালে। বাস্তবে হয়েও ছিল তাই। এই মানুষগুলো দিনের-পর-দিন, মাসের--পর-মাস, বছরের-পর বছর, যুগের-পর-যুগ ধরে এই ডাক্তারেদের বেতন যুগিয়েছে অথচ আজ এদের দুঃসময়ে পাওয়া যাবে না। হায়, দেশের অভাগা মানুষেরা! এরা কেবল মরেই বেঁচে যায়।

পরে পত্রিকায় দেখছিলাম, ২০ জন মারা গেছে, আহত পাঁচশ। কেবল আমাদের হাসপাতালেই মারা গেছে অন্তত দশজন যদিও সরকারিভাবে বলা হয়েছে পাঁচজন। সংখ্যা কমিয়ে বলার একটা নিয়ম আছে। ভাবখানা এমন টর্নেডোও সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। আর যাদের অবস্থা অতি গুরুতর বলে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল এদের হিসাব কে রাখে! এদের অধেকাংশই যে মারা যাবেন এতে অন্তত আমার কোনো সন্দেহ ছিল না।

এমনিতে মানুষ মারা না-গেলে আমরা খুব একটা গুরুত্ব দেই না। কিন্তু অনেককে আমি এমনটা দেখেছি, বাচ্চার চোখ গলে গেছে, কারো নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে এসেছে, কোনো মহিলার শিরদাঁড়া ভেঙ্গে গেছে। একজন তাঁর বেরিয়ে যাওয়া নাড়িভুঁড়ি নিজেই চেপে ধরে বলছেন, 'ডাক্তার সাব, এইটা সিলাই কইরা দেন আমি বাঁইচা যামু'। কিন্তু এখানে কোথায় এর চিকিৎসা- একটা ওটি পর্যন্ত নাই। আমি নিশ্চিত, মৃতের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি হবে।

ভাল কথা, যে ৫৪ জন সামরিক বাহিনীর ডাক্তারকে পাঠানো হয়েছে এরা কোথায়? জানা গেছে এরা সবাই ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়। সবই জেলাকেন্দ্রিক, আমি তো আজও এদের কাউকে আমাদের হাসপাতালে দেখিনি। আর আমাদের হেলিকপ্টারগুলো কী কেবলমাত্র আমাদের বেতনভুক্ত লোকজনের ব্যবহারেরই জন? আমার মনে আছে, এক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হেলিকপ্টারে করে আমাদের এখানে উড়ে এসেছিলেন। কেন? একটা ফায়ার ব্রিগেডের অফিস উদ্বোধন করার জন্য! এরা পারলে বাথরুম উদ্বোধন করার জন্যও চলে আসেন। শোনেন, আমাদের দেশে বাথরুম যে কেউ উদ্বোধন করে না এমন না [১] । আমার মাথায় আসে না এটা কী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাজ? আর ফায়ার ফাইটিং একটা স্টেশন হয়েছে ভাল কথা, এটার উদ্বোধন নিয়ে হইচই করার কী আছে!  

যা হোক, সেই সময়টায় বড় কষ্ট হচ্ছিল, কোথায় যাই, কার কাছে যাই, কী করি- আক্ষরিক অর্থেই মস্তিষ্ক জমে গিয়েছিল। শ্লা, কেন ভাল করে লেখাপড়াটা করলাম না, ডাক্তার হতে পারলাম না। সবাই যখন ঝাঁপিয়ে লেখাপড়া করে তখন আমি গোয়ালঘরে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ি। চুতিয়া আমি, তখন কী জানতাম কী ভুলটাই না করছি।
এই দেশের কোনো পেশার প্রতি আমার আগ্রহ নাই, বিচিত্র কোনো এক কারণে সেটা যদি প্রেসিডেন্ট অভ অর্ডার অনুযায়ী এক নাম্বারও হয়, তবুও। কেবল ডাক্তারি পেশাটা ব্যতীত। আহ, ডাক্তার, একজন দ্বিতীয় ঈশ্বর! এই পেশাটার প্রতি আমার পেটভরা ঈর্ষা! কখনও-কখনও এই কষ্টটার তীব্রতা বাড়ে যেমনটা হয়েছিল এই মাটাকে দেখে [২]

হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছি। কিন্তু এরিমধ্যে একটা অভাবনীয় কান্ড ঘটে গেল! হাসপাতালে ইলেকট্রিসিটি নাই। কেউ কয়েক বান্ডিল মোমবাতি নিয়ে হাসপাতালে ছুটছে। কেউ ক্রেটভরা পানির বোতল নিয়ে। যে ছেলেটা টিউশনি করে দিনযাপন করে সেও ছুটছে এককাঁদি কলার ছড়া নিয়ে। মানুষের-পর-মানুষ আসছেন মাথায় করে কাপড়ের গাট্টি নিয়ে।
অনেককে আনা হয়েছিল হাসপাতালে প্রায় উলঙ্গ, কী নারী, কী পুরুষ! অনেকে আসছেন বিভিন্ন ধরনের খাবার নিয়ে। একসময় দেখা গেল হাসপাতালে খাবার আর কাপড় রাখার জায়গা নাই। যে মানুষটাকে কখনও গুরুত্ব দেইনি সেই মানুষটা আস্ত একটা জেনারেটর ভাড়া করে নিয়ে এসেছেন, সারা রাত্র এই জেনারেটর চলবে। পরবর্তীতে এই কাজটা যে কী অসাধারণ একটা কাজ হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

হাসপাতালে আইভি ফ্লুইড স্যালাইন আছে কিন্তু স্যালাইন লাগাবার সামান্য যন্ত্রপাতি নাই। ভায়োডিন নাই!

আমার যে বন্ধুটিকে কখনও দেখিনি ফকিরকে চারআনা পয়সা দিতে। সেও দেখি হাজার টাকার নোট বার করে ওষুধের দাম পরিশোধ করে। চোখের জল কী বাঁধ মানে, শ্লা! জীবনের কাছ থেকে আবার নতুন করে শিখি। আসলে এই পৃথিবীটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় পাঠশালা, শেখার ইশকুল!

আমার মনে পড়ে সেই কথাটা। সমুদ্রের ঢেউয়ে হাজার-হাজার মাছ ডাঙ্গায় চলে এসেছে, পানি সরে যাওয়ার পর মাছগুলো খাবি খাচ্ছে। অতি সাধারণ একজন দুই হাতে মাছগুলো ছুঁড়ে ফেলছেন পানিতে। আর সৈকতে পিকনিকে আসা 'আমার মত গা বাঁচিয়ে চলা'  অনেকগুলো মানুষ আড্ডা দিচ্ছিল। এরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে আর কেবল হাহা-হিহি-হোহো। এদেরই একজন সেই মানুষটাকে অবজ্ঞাভরে বলছে, 'হেহেহে, এ ভাবে কটা মাছের প্রাণ বাঁচাবেন'?

সেই মানুষটা কেবল দুহাতে মাছ পানিতেই ছুঁড়েই যাচ্ছেন, তাঁর সময় কোথায়! কেবল একবার মুখ খুললেন, 'আপনারা হাত লাগালে আরো অন্তত পঞ্চাশ গুণ মাছের প্রাণ বাঁচত'।

বাসায় যখন ফিরি তখন অনেক রাত। ইলেকট্রিসিটি নাই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। মশারা সব ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমার উপর কিন্তু ঘুম হয় গাঢ়। যাক বাবা, অন্তত বিবেক নামের রাস্কেলটার যন্ত্রণা তো আর সইতে হচ্ছে না...। 

সহায়ক সূত্র:
১. বাথরুম উদ্বোধন: http://www.ali-mahmed.com/2009/12/blog-post_20.html
২. মা এবং তাঁর অদেখা সন্তান: http://www.ali-mahmed.com/2010/02/blog-post_10.html

No comments: