Search

Wednesday, February 15, 2012

একজন সাগর এবং নড়বড়ে সাঁকোটা

ছবি ঋণ: আরাফাতুল্ ইসলাম
সাগর সরওয়ারের সঙ্গে তেমন স্মৃতি নাই আমার। আমার সঙ্গে একবারই দেখা হয়েছিল। ডয়চে ভেলের অফিসে। জার্মানিতে আমার সময়টা ছিল স্বল্প আর আমি ছিলাম দৌড়ের উপর। উল্লেখ করার মত স্মৃতি থাকার কথা না কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার স্মৃতি এখনও দগদগে কারণ...।
কারণটা উল্লেখ করা আমার জন্য আরামের না বলে খানিকটা বিব্রত বোধও যে করছি না এমন না। আমি তখন ধুমসে স্মোক করি। মানুষটার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আমার তোতাপাখির মত একটাই সংলাপ ছিল, 'দেন দিকি, একটা সিগারেট দেন'।
মানুষটা হাসিমুখে সিগারেট বাড়িয়ে দিতেন। রাইন নদী ধোঁয়ার আড়ালে!

আজও ধোঁয়ার আড়াল থেকে বিব্রত ভঙ্গিতে বলি, এখনও, কখনো সখনো স্মোক করি। সেধে গাধা হই...।

তা বিষয়টা কেন আমার জন্য বিব্রতকর এটা ইরশাদ করি। আমি স্মোক করি, এটা বলে সেধে কে নির্বোধ হতে আগ্রহ দেখাবে! আমার নিজের সম্বন্ধে ধারণা কেমন এটা কেউ জানতে চাইলে আমি অকপটে স্বীকার যাব, এই গ্রহে এক নাম্বার নির্বোধটা হচ্ছি আমি কারণ আমি স্মোক করি।
স্মোক করি, ধুর বারবার ইংরাজি শব্দ নিয়ে আসছি কেন? বাংলায় খানিক ঝামেলা হয়ে যায় বটে! সিগারেট টানি, সিগারেট পান করি এটা কানে খট করে লাগে আবার যদি বলি সিগারেট খাই তখন আবার কেউ কথাটা খপ করে ধরে ফেললে? মিয়া, সিগারেট আবার খায় কেমনে! তখন তো একটা 'ঝালেমা'-ঝামেলা হয়ে যাবে। সিগারেট কেমন করে খায় এটা নিয়ে কেউ হইচই করলে তাদের এটা বলা ব্যতীত উপায় কি, বাপু রে, সিগারেট চিবিয়ে খাই, কোনো সমস্যা?

তো, আমি সিগারেট খাই এটা বলে আরাম পাই না। ওই যে বললাম, নির্বোধ হওয়ার ভয় (এটা আমার নিজস্ব অভিমত)। বড় বড় মানুষদের কাছে অবশ্য এটা নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। আমাদের হুমায়ূন আহমেদ স্যারের হাতে সিগারেট, এটা নিয়ে ঘটা করে বিচিত্রায় প্রচ্ছদও ছাপা হয়েছিল।
হালে দায়ে পড়ে তিনি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু...। সম্প্রতি এক লেখায় তিনি লিখেছেন, "...পরিচিত কাউকে সিগারেট খেতে দেখলে আমি তার পিঠে হাত রেখে বলব, আরাম করে খাও! আমি দেখি..."।
ভাল-ভাল! এই মেসেজে তিনি তাঁর অপরিণত পাঠকদের জন্য কি দিকনির্দেশনা দিতে চান এটা তিনিই ভাল বলতে পারবেন! মানুষটার লেখালেখির অসাধারণ ক্ষমতাটা সরিয়ে নিলে, স্রেফ আপাদমস্তক একজন পোকা-পোকা টাইপের মানুষ!

যাই হোক, এরপর সাগর সরওয়ারের সঙ্গে আমার তেমন যোগাযোগ ছিল না। অনেক আগে করা আমার এক লেখায় কালই তাঁর একটা মন্তব্য চোখে পড়ল। প্রকাশকের উপর তাঁর দেখি ভারী রাগ। ওই লেখাটায় মন্তব্যে তিনি আমাকে লিখেছিলেন:
"...তবে একটা কাহিনী বলি শুনুন। এক ফোঁটাও মিথ্যে না৷ আজ থেকে খুব বেশি দিন আগে নয়৷ অফিসের সকাল৷ একটু কাজ কম৷ ফেসবুক খুলে আছি৷ পরিচিত অনেকেই আছেন৷ ... প্রকাশনীর নামে তার ফেসবুক পেজ৷ আমি কথা শুরু করলাম৷ একটু আধটু কথা৷ জানালাম জার্মানি থেকে বলছি৷ এরপর আস্তে আস্তে বললাম, ভাই আমার একটি পান্ডুলিপি আছে৷ আমি আপনার কাছে পাঠাতে চাই৷ পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলন নিয়ে একটি উপন্যাস, 'কর্নেলকে আমি মনে রেখেছি'৷
ইনি বললেন, তাই৷ তারপর জিজ্ঞাস করলেন, আপনার আগে কোন বই আছে?
আমি বললাম, খান-কয়েক৷
তিনি বললেন, তাহলে ওদের না দিয়ে আমাদের দিতে চাইছেন কেন?
আমি সত্য কথাটাই বললাম৷ জানালাম, গত বইমেলায় আমার বইটি একেবারে শেষ দিনে মেলায় আনায় আমি রাগাম্বিত৷
তিনি বললেন, আমাদেরও তো দেরি হতে পারে, তখন কি আপনি এভাবে আমাদেরও গালি দেবেন?
আমি তাকে সংশোধনী দিয়ে বললাম, আমি কাউকে গালি দিইনি৷ আমার রাগ হয়েছে, সেই কথাটি বলেছি৷
এরপর সেই প্রকাশক আমাকে বললেন, বই ছাপানোর জন্য আমরা অনেক চার্জ করি৷
আমি বললাম, আমি টাকা দিয়ে বই ছাপাই না৷
উনি বললেন, তাহলে আপনাকে বেশ কিছু আপনারই বই কিনে নিতে হবে৷
আমি বললাম, দুঃখিত, আমি এ কাজটিও করি না৷
উনি বললেন, তাহলে তো আপনার বই আমি বের করবো না৷ আমরা এ ধরণের বই-এ ইনভেস্ট করতে পারি না৷
তারপর নানা কথা হলো৷ উনি উনার কথা জানালেন৷ কেন তাকে এমন করতে হয়৷ এরপর তিনি ঢাকায় আসলে এক কাপ চা খাবার আমন্ত্রণ দিলেন আমাকে৷
একটিবারের জন্য ওই প্রকাশক দেখতে চাইলেন না উপন্যাসের পান্ডুলিপি৷ আমি অবশ্য তাকে একটা লিঙ্ক পাঠিয়েছিলাম৷ প্রকাশকরা কি বদলে যেতে শুরু করেছেন?" 

সাগরের মন্তব্যটা পড়ে মনটা অন্য রকম হচ্ছিল, আহা, আজ এই মানুষটাই সমস্ত রাগ-ক্ষোভের বাইরে চলে গেছেন। কেমন করে, একজন মানুষ কেমন করে দুম করে নাই হয়ে যায়!
তাঁর ওই ক্ষোভের মন্তব্যটা পড়ে তখন এড়িয়ে গিয়েছিলাম কারণ এ তো আর নতুন কিছু না!

একজন সাগর সরওয়ারের মৃত্যু অনেক হিসাব ওলট-পালট করে দেয়। রাজনীতিবিদদের বালকসুলভ কথা শুনে হাসাটাও আমার কাছে শ্রমসাধ্য মনে হয়। তারা গলাবাজি করছেন, এই সরকারের আমলে সাংবাদিকও রেহাই পায়নি। কী হাস্যকর, কী হৃদয়হীন কথাবার্তা! সাংবাদিকের মৃত্যু হলে এরা নড়েচড়ে বসেন তাহলে অন্য মৃত্যু কি, বাদামের খোসা?
এমনিতে অনেকে বিষয়টা বুঝতে পারছেন না। সাগর দম্পতি কিন্তু খুন হয়েছেন বাসার ভেতর। এবং এখন পর্যন্ত জোর অনুমান খুনি তাঁদের পূর্বপরিচিত। এখন আমার কাছের লোকজনেরা যদি আমাকে খুন করে, আহত করে এখানে তো সরকারের কোনো হাত নাই। বরং সরকারের হাত থাকলেই সর্বনাশ হবে। ওহো, এরা সম্ভবত আশা করছেন বাথরুম যাওয়ার পূর্বেও সরকারকে জানিয়ে যেতে হবে!

সরকারের যেটা ভূমিকা সেটা হচ্ছে খুনি যেই হোক তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। এখানেও সরকার তাদের প্রতিভার (!) ছাপ রেখে যাচ্ছেন। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ৪৮ ঘন্টার মধ্যে খুনিকে পাকড়াও করা হবে।
ভাগ্যিস, দেশটা উন্নতবিশ্ব না নইলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ফট করে বলে বসতেন, খুনি তো মনে হয় আপনার খাটের নীচে। ৪৮ ঘন্টা কেন, পারলে আপনি এখনই খুনিকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসুন না, আটকাচ্ছে কে!
ঘন্টা বেঁধে দিয়ে খুনিকে আটকানো সম্ভবত এই অসম্ভবের দেশেই সম্ভব। 'ক্যাচ মি, ইফ য়্যু ক্যান', খুনি কি পশ্চাদদেশে এই তকমা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়?

আর মিডিয়া... আহ, মিডিয়া! প্রথম যেদিন শুনলাম সাগর দম্পতির একমাত্র সন্তান মেঘকে তার নানু বাড়িতে সরিয়ে ফেলা হয়েছে এটা জেনে চেপে রাখা শ্বাস ফেলেছিলাম। কিসের কী! ব্লাড-হাউন্ড যেমন শুঁকে শুঁকে ঠিক হাজির হয়ে যায় তেমনি আমাদের মিডিয়াও। কে জানে, হয়তো সাগর দম্পতির স্টোরির উপর নির্ভর করছে অনেক সাংবাদিকের প্রমোশন। সম্পাদক-এডিটর ভাইয়ারা পিঠে থাবড়া মেরে বলবেন, ওয়েল ডান, মাই বয়, ওয়েল ডান।
কেউ কেউ মরে বেঁচে যান কিন্তু তাঁর প্রিয় মানুষেরা বেঁচে থেকেও মিডিয়ার হাতে মারা যান, অনবরত। সন্তানের শব সামনে নিয়ে মাটা যখন কাঁদেন তখন মিডিয়ার চুতিয়া লোকজনেরা ঢাউস ক্যামেরা তাক করে রাখেন মাটার মুখে। মার বুকভেঙ্গে কান্নার রগরগে একটা ছবি তার যে চাই, চাই-ই।
বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লোকজনেরা মার মুখের সামনে বুম ধরে বলবেন, 'আপুনি এখন কেমুন বোধ করিতেছেন...'।
আফসোস, আজ পর্যন্ত এদের কেউ পায়ের চটি খুলে এদের বেদম পিটায়নি। পিটিয়ে এটা বললে চমৎকার একটা কাজ হতো, "এখন 'ভালু' বোধ কচ্চি"। এমন অবস্থায় কেউ চটি দিয়ে পেটালে সেই 'চটিবাজ'কে আমি হাজার-হাজার মানুষের সামনে পা ছুঁয়ে কদমবুসি করব, আমার লেখালেখির শপথ।
আজ সিমু নাসেরের চমৎকার একটা লেখা ছাপিয়েছে প্রথম আলো, 'ছোট মেঘ, বড়দের ভুল' [১]। আমার অনেক না-বলা কথা এখানে বলা হয়ে গেছে- চর্বিতচর্বণ আর করি না।

মিডিয়ার এই সবই পুরনো খেলা এই নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নাই। কিন্তু...। আমাকে যেটা ভাবাচ্ছে, সাগরের এই মৃত্যুটা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে কি কোনো কিছু বলার চেষ্টা করছে? এটা কি আমাদের জন্য কোনো আগাম বার্তা?
পূর্বে যেটা উল্লেখ করেছিলাম, এখন পর্যন্ত আমরা যতটুকু জানি তাঁদের মৃত্যুটা হয়েছে তাঁদের নিজের বাসায় এবং খুনি তাঁদের পরিচিত। ক্যারিয়ার নামের অসভ্য দৌড়ে আমরা কী ক্রমশ আমাদের নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলছি? আমরা যেটাকে 'ভ্যালুজ' বলি তা কি ক্রমশ উবে যাচ্ছে?
ঘোর যুদ্ধ চলত কিন্তু কেউ অন্যের আমন্ত্রণে তার তাবুতে গেলে নিজের শিরস্ত্রাণ খুলে ফেলত। মেসেজটা পরিষ্কার, আমি এখন তোমার দায়িত্বে, আমার মাথা অরক্ষিত। এখন এই মাথা রক্ষার দায়িত্ব তোমার, আমার না। কে জানে, পশ্চিমাদের এই কেতাটা, কারও বাসায় গেলে টুপি খুলে ফেলা এটা কি এখান থেকেই এসেছে?

তো, যেখানটায় আমরা নিজেকে সুরক্ষিত মনে করি, সেটা আমাদের, আমাদের বাসস্থান। যেখানে ঘিরে থাকেন প্রিয়মানুষ-সুহৃদ-পরিচিত লোকজনেরা, সামাজিক নিরাপত্তার এক দৃঢ় বলয়। এখন এদের মধ্যে থেকেই যদি কেউ ছুঁরি লুকিয়ে নিয়ে আসেন তাহলে তো আর আমাদের দাঁড়াবার জায়গা থাকে না। তখন আমরা কোথায় দাঁড়াব? ঈশ্বর, দাঁড়াবার জন্য একচিলতে মাটি যে বড়ো প্রয়োজন।
কার কথা এটা? 'বাটহীন ছুঁরি, যে মারে সেই সবচেয়ে বেশি রক্তাক্ত হয়'। তার চেয়ে জরুরি যেটা আমাদের বিশ্বাসের যে গোপন জায়গাটা সেই জায়গাটায় আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কুৎসিত নখের ছাপ। আমি আগেও বলেছি, 'আমাদের সবার মধ্যে একটা শিশু এবং একটা পশুর বাস। এদের মধ্যে হরদম মারামারি লেগেই আছে। কখন কে জিতকে তা আগাম বলা মুশকিল। তারপরও আমাদের সবিরাম চেষ্টা থাকে পশুটাকে পরাজিত করার...'।
যে পশুটাকে আমরা বিভিন্ন কায়দায় লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করি, পরাজিত করার চেষ্টা করি, সবিরাম। সেই পশুটাই দেখি এখানে উম্মুক্ত, সদর্পে মাথার উপর বনবন করে ছড়ি ঘোরাচ্ছে!

আমাদের বিশ্বাসের জায়গাটা বড়ো নড়বড়ে হয়ে গেছে। এখন থেকে আমরা কি কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারব না? পরিচিতের, বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে কারও সামনে দাঁড়াতে কথা জড়িয়ে যাবে? বা অহেতুক লাজ, সামনে দাঁড়ানো মানুষটা কি আমাকে ভয়ের চোখে দেখছে?
বিশ্বাসের নদীটা আমরা পার হই যে সাঁকোটা দিয়ে সেই সাঁকোটা যে বড়ো নড়বড়ে হয়ে গেল...!

 
সহায়ক সূত্র:
১. ছোট মেঘ, বড়দের ভুল: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-02-15/news/224710 

No comments: