Search

Monday, November 28, 2011

হাসপাতাল পর্ব: দুই

ঈদের পর পরই যানজটের হ্যাপা থাকার কথা না তবুও আমি ঝুঁকি নিলাম না। ভোর পাঁচটায় রওয়ানা হলাম। অ্যামবুলেন্স ঝড়ের গতিতে ছুটছে। ছোটবোনটা মার হাত ধরে বসে আছে। আমি ইচ্ছা করেই সামনে বসেছি। মার মুখটা কী পান্ডুর। তবুও কী তীব্র তাঁর চোখের দৃষ্টি! এই দৃষ্টি পড়ার ক্ষমতা আছে কেবল নিজ সন্তানের। পারতপক্ষে আমি মার চোখে চোখ পড়ুক এটা চাচ্ছিলাম না, আপ্রাণ চেষ্টায় এড়িয়ে যেতে চাচ্ছিলাম।


আড়াই ঘন্টায় যাত্রাবাড়ি! কেবল কমলাপুরের কাছে এসে খানিকটা সমস্যা হলো। একটা সরকারী গাড়ি কিছুতেই অ্যামবুলেন্সকে আগে যেতে দেবে না। কে শোনে সাইরেন- কোনো কিছুকেই এ গা করছে না! অ্যামবুলেন্সের চালককে বিড়বিড় করে আমাকে বলছেন, এর বিবেচনাটা দেখেন। জানোয়ার-জানোয়ার!
আমি তাঁকে বললাম, চেষ্টা করতে থাকেন। যেখানে এটাকে পাশ কাটাবেন তখন খানিকটা স্লো করবেন।

অবশেষে সেই সময়টা চলে আসে। চলন্ত গাড়িতে থেকেই আমি যে ভঙ্গি করলাম এর সঙ্গে ভদ্রসমাজের কোন যোগ নেই। শ্লা, আমি আবার কবে দাবী করলাম আমি ভদ্র একজন মানুষ! ওই ড্রাইভারটা দেখলাম মধ্য-বয়স্ক একজন মানুষ! আমার ধারণা ছিল ছোকরা টাইপের কেউ হবে। আবারও মেজাজ খারাপ হয়- ভঙ্গিটা আবারও না-করে উপায় থাকে না আমার। আমার আচরণ দেখে মধ্য-বয়স্ক ওই মানুষটাকে দেখি জিহ্বায় কামড় দিতে।

গ্রীন রোডের ক্রিসেন্ট গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে দু-মাস আগে এসে গেছি কিন্তু আমি লোকেশন ভুলে গেছি। আমি এবং আমার কুখ্যাত স্মৃতিশক্তি! প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো মনে থাকে না। মানুষটা আমি অখ্যাত হলেও এই একটা বিষয়ে বিখ্যাত [১] [২]
ঠিকানা জিজ্ঞেস করায় কয়েকজন ভুল তথ্য দিলেন। বড়ো বিচিত্র এই দেশ, এখানে ধর্মীয় অনুশাসন পালন না-করলে ঘোর অন্যায় হয় এটা শেখানো হয় কিন্তু একটা অ্যামবুলেন্সকে ভুল রাস্তা ধরিয়ে দিলে আদৌ অপরাধ হয় কিনা এটা শেখানো হয় না।

অবশেষে ক্রিসেন্টে ফোন করে অ্যামবুলেন্স চালককে ধরিয়ে দেই। এই 'ভুলভুলাইয়া' পর্বের এখানেই সমাপ্তি!
এই হাসপাতালের কেবিনগুলোর একটা বৈশিষ্ট আছে। প্রত্যেকটা কেবিনের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমে বাথটাব! এরা রোগীর জন্য বাথটাব বসিয়েছে এটা পাগলও বিশ্বাস করবে না। ঘটনাটা অনুমান করতে পারি, আগে এটা ফ্ল্যাটবাড়ি ছিল, এখন হাসপাতাল বানিয়েছে। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে বাথটাবগুলো গুড়িয়ে দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না-বিধায় রেখে দিয়েছে।

কপাল আবারও ... ডাক্তার [৩], ডাঃ তৌহিদুল আলম আসলেন প্রায় সন্ধ্যায়। এই বিখ্যাত মানুষটা নিয়ে আমি খানিকটা ধন্ধে আছি। এই মানুষটার মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করে। আমি ভয়ে সিটিয়ে থাকি এ কোথায় না-একটা ভুল করে বসে। কিন্তু নিজেকে প্রবোধ দেই এই মানুষটা নিজ পেশায় বিখ্যাত এবং আমার কাছের একজন মানুষ এঁর বিস্তর সুনাম করেছেন।
তিনি একটা শর্ট কলোনস্কপি করলেন। ওখানে মন্তব্যে লিখেলেন:
"Findings consistent with sigmoid volvulous." Advice: Surgery

তাঁর সার্জারি বিষয়ে আমার কোন দ্বিমত ছিল না কারণ এই ভয়টাই আমি করছিলাম। মার পক্ষে এই বয়সে অপারেশনের ধকল নেয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। ডাক্তারের সঙ্গে বিশদ আলাপের কোন সুযোগই নাই। হড়বড় করে কীসব বলতে থাকেন যা আমার মত সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয় না। লাফাতে লাফাতে মানুষটার বেরিয়ে যাওয়ার তাড়া। কেবল এটুকুই বোঝা গেল, এক্স-রে করে 'গ্রীন লাইফ হাসপাতালের চেম্বারে আমাকে দেখাবেন।
এখানে আবার ডিজিটাল এক্স-রে হয় না।

আমার জানামতে, এই দেশে আলাদা করে গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল দুটাই আছে এইটা গ্রীনরোডে এবং আরেকটা পান্থপথে। আজিব, এক্স-রে নাই! এটা করাবার জন্য তিন-চার বিল্ডিং পরেই গ্রীন লাইফে যাওয়া যায় কিন্তু রোগী যাবে কেমন করে? এই সামান্য পথটুকুর জন্য আবারও অ্যামবুলেন্সের সহায়তা।
এক্সরে দেখে তৌহিদুল আলম ফড়ফড় করে বললেন, নাড়িভুঁড়ি সব পেচাইয়া গেছে। কী অপারেশন করব! ভেতরে জোড়া থাকবে না, সব খুলে আসবে।
মানুষটার কথা বলার ভঙ্গি দেখে আমার কেবলই মনে হচ্ছিল এই মানুষটা এই গ্রহের বিখ্যাত ডাক্তার হলেও আচার-ভঙ্গি শেখার জন্য প্রাইমারি স্কুলে এর ভর্তি হওয়া আবশ্যক।

আমি অদম্য রাগ সামলে ম্লান গলায় বলি, অপারেশন না-করলেও তো রোগীর যে অবস্থা...।
এরপর ডাক্তার বলেন, ঠিক আছে, তাহলে কালকে পেট কেটে ফেলি।
এই ডাক্তারটাকে কে বোঝাবে তিনি একটা তেলাপোকা নিয়ে কথা বলছেন না, বলছেন আমার মাকে নিয়ে। আর আমিই কী এটা জানি ছাই, তৌহিদুল আলমের মত ডাক্তারদের জন্ম দেয়ার জন্য মার প্রয়োজন হয় না; ডাক্তারি যন্ত্রপাতিই যথেষ্ঠ!
*হাসপাতাল পর্ব: এক

**সবগুলো পর্ব: http://tinyurl.com/boya6xk

সহায়ক সূত্র:
১. কুখ্যাতি: http://www.ali-mahmed.com/2009/08/blog-post_9358.html
২. ...সারায় অসুখ: http://www.ali-mahmed.com/2009/10/blog-post.html
৩. ...ডাক্তার: http://www.ali-mahmed.com/2011/08/blog-post_27.html 

অফ-টপিক: আফসোস, দেশটা ভরে যাচ্ছে চুতিয়ায়...।

     

2 comments:

Nuhan said...

Thamben na, pls

Anonymous said...

এই গল্পের ভার আমি নিতে পারছিনা। আমি ডাক্তার তাই বলে নয়। এই বেদনার ভার বহন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কেন যেন মনে হয় ডাক্তার হলেই সব মৃত্যুকে সহজ ভাবে নিতে হবে তার কোন মানে নেই।
নিজেকে অপরাধী মনে হয় কোন কোন সময়। আমি আর কোন দিন ঈদের সময় ছুটিতে যাবনা।