জামিকে, আড়ালে আবডালে আমরা তার বন্ধুরা ছোকরা-বালক ডাকতাম। ব্যাটা এমন পুতুপুতু! কখনও কখনও ওর আচরণ দেখে বিরক্ত হব কী, লজ্জা করত খুব!
একবার নিশুতি রাতে ফোন করল। সমস্যা কি? ওর ভাষায় গুরুতর সমস্যা।
কী হয়েছে? ও নাকি অকূল পাথারে হাবুডুবু খাচ্ছে! রাতে দাঁত ব্রাশ করে বেসিনে কুলি করতে গিয়ে দেখেন কয়েকটা কাল পিঁপড়া। ওর ভাষায়, পিঁপড়া রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা পড়ে, ওয়াকস আ মাইল... আউড়াচ্ছে আর বেদম পায়চারি করছে। এরা নাকি বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে চলে এসেছে। তো, জামি মিয়ার সমস্যা হচ্ছে, সে বেসিনে কুলি করতে পারছে না, পানি ঢেলে দিলে এরা নাকি ভেসে যাবে।
আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম, টানাটানি করে বেসিন খুলে বেসিনের পাইপে মুখ লাগিয়ে কুলি করতে। এই নিয়ে রাগ করে ক-দিন আমার এখানে আসাই ছেড়ে দিল।
পাগল-ছাগল যাই হোক জামি নামের এই মানুষটাকে আমি বিচিত্র কারণে পছন্দ করি। এর মধ্যে অদেখা এক সরলতা আছে। যেচে আমিই যাই ওর বাড়িতে। একদিনের কথা, অরি আল্লা, আজ এখানে দেখছি আরেক জটিল কাহিনী! কাকের এক বাচ্চাকে নিয়ে পড়েছে। কাকের বাচ্চাটার ডানা ভাঙ্গা, মৃতপ্রায়-মরমর অবস্থায় নাকি ছিল। একটা টুকরিতে করে কাকের বাচ্চাটাকে উঁচু একটা জায়গায় রেখেছিল, পাশে প্লাস্টিকের বাটিতে পানি। দুয়েক ফোঁটা পানি নাকি কাকের বাচ্চাটা খেয়েও ছিল। এজন্য জামিকে নাকি নানা কায়দা-কানুন করতে হয়েছিল। রাজ্যের কাক এসে কা কা করে ওর কানই কেবল ঝালাপালা করে দেয়নি, দু-চারটে ঠোকরও দিয়েছিল। লাভ হয়নি। শেষঅবধি কাকের বাচ্চাটা মরেই গেল।
জামির চোখ আর্দ্র নাকি আমার দেখার ভুল বলতে পারব না। চোখ ঘুরাবার জন্য নাকি কথা ঘুরাবার জন্য জামি হড়বড় করে বলল, চিন্তা কর, কাক কেমন বেকুব জাতি!
আমি হি হি করে বললাম, কাউয়া জাতি? আরি, বেকুব কয় কী!
জামি বিরক্ত হয়ে বলল, হাসছিস কেন? কাক বেকুব না? চিন্তা কর, মানুষ কাক খায় না তারপরও কাক মানুষকে বিশ্বাস করে না। অথচ দেখ, মানুষ কবুতর পেলেই কপ করে খেয়ে ফেলে তবুও মানুষের প্রতি কবুতরের অবিশ্বাস নাই। কেমন লেজ নেড়ে দিব্যি বাকুম-বাকুম করে।
আমি এইবার হাসি গোপন করে বললাম, আচ্ছা যা আর হাসব না, ঘাট হয়েছে। চল তোর সঙ্গে কথা আছে।
জামি বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, দাঁড়া, এইটার একটা ব্যবস্থা করি।
আমি এইবার আক্ষরিকার্থে বিরক্ত, জাস্ট ছুঁড়ে ফেল। এক মিনিটের মামলা। দে আমার কাছে, দেখ কেমন হাত ঘুরিয়ে হুই করে ছুঁড়ে ফেলি। ফুটবলের মত একটা কিক দিলেও হয়, কি বলিস?
জামি আহত চোখে তাকিয়ে রইল।
আমি বললাম, ভুল কিছু বললাম নাকি। বিষয়টা কী বল দেখি, তুই কি এইটার কবর দিবি!
না ইয়ে মানে, কবর-টবর না। অন্তত মাটি খুড়ে...।
তাহলে একটু সবুর কর, হুজুর ডেকে নিয়ে আসি।
জামি হিসহিস করে বলল, তুই যা, তোর সাথে কথা বলতে আমার ভাল লাগছে না।
আমার বিরক্তির একশেষ। তোর এখানে থাকতে আমার বয়েই গেছে। হুশ কুত্তা, হুশ।
সে-বার দুর্দান্ত রাগ নিয়ে চলে এসেছিলাম।
সুবির আর আমি আড্ডা দিচ্ছি। আড্ডা দিচ্ছি কথাটায় খানিকটা ভুল আছে। সুবির আড্ডা দিচ্ছে আমি সঙ্গ দিচ্ছি। একে জামহুরিয়াত-গণতান্ত্রিক শাসনের সময় দিব্যি দেখা যায় ক্ষমতাশীন দলের হয়ে মহড়ায় অস্ত্র ঝোলাতে। এটা শোনা কথা, যাচাই করে অবশ্য দেখা হয়নি। কিন্তু অন্য সময়-জরুরি অবস্থায় টিকিটিও চোখে পড়ে না! এমন একজন উঠতি মাস্তানকে সঙ্গ দিতে অস্বীকার করাটা মুশকিল না?
অনেক দিন পর জামিকে আমাদের বাসায় দেখে থমকালাম। এই ক-দিন যোগাযোগ করেনি। কোথায় ছিল কে জানে। জামি চুপচাপ বসে পড়ল। চশমার কাঁচ অকারণে পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে।
সুবির একমুখ হেসে বলল, কি জামি মিয়া, তুই কি কাউয়ার চল্লিশার দাওয়াত দিতে আসলি?
জামি আমার প্রতি চট করে তাকিয়ে মাথা নীচু করে নিল। তার দৃষ্টিতে বেদনা। ওর বুঝতে বাকী নাই এটা আমার কান্ড! এক্ষণ বুঝলাম কাজটা ঠিক হয়নি। সুবির এটা জনে জনে বলে বেড়াবে, অহেতুক টেনে টেনে রাবার লম্বা করবে।
জামি উত্তর না দিয়ে প্রায় নিঃশব্দে সিগারেট ধরালো।
সুবিরের মুখে ফিচেল হাসি, বললি না জামি, মুখ কি সেলাই কইরা রাখছস? তোর মা এমন একটা হিজড়া জন্ম দিল, আহারে!
জামি বিড়বিড় করে বলল, যা বলার আমাকে বল, আমার মাকে নিয়ে কিছু বলবি না, প্লিজ।
সুবির জামির সিগারেটের প্যাকেটটা চকিতে তুলে নিয়ে বলল, বললে, কি করবি হিজড়াবাবু?
কখন এরা কথা কাটাকাটির চরমে চলে গেছে এটা বুঝে উঠার আগেই সুবিরের এটা বলা শেষ, তোর মাকে আমি...। তাহলে অন্তত তোর মত হিজড়ার জন্ম হবে না এই, গ্যারান্টি দিতে পারি।
জামি ভাঙ্গা গলায় বলল, সুবির আর একটা কথা বলবি না আমার মাকে নিয়ে।
সুবির দাঁত বের করে বলল, বললে? কি করবি রে হিজড়াবাবু? তুই তো হিজড়াই। ভুল বললে প্রমাণ দে, প্যান্ট খোল।
জামি আর একটা কথাও বলল না। সুবির জামির সূক্ষ্ম পরিবর্তন লক্ষ করেনি। ও ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছিল, অনবরত ভাঙ্গচুর হচ্ছিল জামির মধ্যে। চশমার পেছনে জামির যে চোখটা, এক্ষণ অবিকল মরা মানুষের চোখ! সুবির এ-ও লক্ষ করেনি, জ্বলন্ত সিগারেটটা এখন আর জামির আঙ্গুলে নাই, তালুতে চেপে রেখেছে। জামির তীব্র ক্রোধের কাছে সিগারেটের আগুন ক্রমশ পরাস্ত হচ্ছিল, একসময় হাল ছেড়ে দিল, নিবে গেল। কেবল বাতাসে ভেসে বেড়াতে থাকল সূক্ষ্ম চামড়া পোড়ার গন্ধ।
বেরিয়ে যেতে যেতে জামি হিম গলায় বলল, সুবির, তোর সঙ্গে আবার আমার কথা হবে, ঠান্ডা মাথায়। তখন তোর প্রলাপ শুনব। প্রার্থনা করিস, তোর সঙ্গে আবারও দেখা হওয়ার আগেই যেন আমি মারা যাই।
সুবিরের তাচ্ছিল্যের হাসি উপেক্ষা করে জামি বেরিয়ে গেল। হাঁটার ভঙ্গিতে তার অজান্তেই একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। দু-হাত শরীর থেকে বেশ খানিকটা দূরে দূরে থাকছে!
ক-দিন পর সুবিরের ক্ষতবিক্ষত উলঙ্গ লাশ পাওয়া গেল, ব্রীজ থেকে ঝুলন্ত, বিশেষ একটা অঙ্গ উধাও!
জামিকে ওর বাসায়ই পেলাম। ঘুম থেকে ডেকে তুলতে বেগ পেতে হল। খবরটা শুনে ও হাঁই তুলল। পারলে এখুনি শুয়ে পড়ে, শয়ালু ভাব! মুখে বলল, স্যাড, ভেরি স্যাড।
আমি উসখুস করে বললাম, জামি, তুই...?
পাগল, কাউকে মেরে ফেলার সাহস আমার আছে নাকি আমার। সুবির কি বলেছিল শুনিসনি? আমি নাকি হিজড়া!
মিথ্যা বলিস না, জামি!
জামি আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল, আরে, তুই দেখি এইটা নিয়ে পড়লি। ওকে আমি মারিনি, বললাম তো। ওর ঠোঁটটা কেবল মাছ ধরার বড়শি দিয়ে সেলাই করে দিয়ে কেবল বলেছিলাম, আমার মাকে নিয়ে ওই কথাটা আবার বলতে। বুঝলি, এতবার করে বললাম, বাঞ্চোতটা বলতেই চাইছিল না। খুব নড়াচড়া করছিল, বুঝলি। কী আর করা. বল, ওর দু-হাতের কব্জি পেরেক দিয়ে টেবিলের সঙ্গে আটকে দিয়েছিলাম। আমার ... দেখিয়ে বললাম, এই দেখ, বিশ্বাস হয় আমি যে হিজড়া না। এইবার তোমার পালা বাপ, তোমায় যে প্রমাণ দিতে হয়। বুঝলি, ও ব্যাটা প্রমাণ দেতে চাইছিল না। এটা কি ঠিক, তুই-ই বল! ওই কথাটা আবার বলতে। বাঞ্চোত কথাই শুনে না। আমার খুব রাগ হল, বুঝলি। একটা মানুষকে কতবার অনুরোধ করা যায়। পরে ড্রিল মেশিন দিয়ে...।
স্টপ জামি, ফ’ গড সেক, স্টপ।
আচ্ছা যা, আর বলব না। তা তুই কি এটা পুলিশকে জানাবি?
আমি গুম হয়ে অধোবদনে বসে রইলাম। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলছি। জামির মত একজনের পক্ষে কেমন করে এটা সম্ভব! কিন্তু ওর পাথুরে চোখ, নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বর্ণনা? নাহ, দু-হাত টেবিলে আটকে থাকলে আমি লেখব কেমন করে? জামির মত আলাভোলা ছেলেটার সহজ-সরল জেনেটিক কোডের তথ্যগুলো আবারও এলোমেলো হবে না এই দিব্যি কে দিয়েছে?
*Das ist meine Welt. Wenn es auch Ihnen gehört, habe ich kein Problem mit Ihnen. Es gibt keinen Grund mit Ihnen zu kämpfen. Weil wir sind Freunde, Verwandte. * この地球は私のものです。たまたまこの地球はあなたのものでもあれば、私はあなたと争わない。あなたは私の兄弟、親族ですから。 * This planet belongs to me. By any chance, if you also claim the ownership of this planet, I have no complain, even I should not have any complain about that. Because you are my brother-relative.
Sunday, August 29, 2010
কাপুরুষ!
বিভাগ
জীবনটাই যখন নিলামে
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment