Search

Sunday, August 1, 2010

এরাই ঠিক করে দেন মানবতার সংজ্ঞা

আজ ক্রুদ্ধ হয়ে একজন মেইল করেছেন। কোন ওজর-আপত্তি শুনতে রাজি না। কেন এটা নিয়ে আমি লিখিনি এর স্পষ্ট জবাব চেয়েছেন।
কেউ একজন আমাকে বলেছিলেন, বিশেষ একটা পত্রিকার প্রতি নাকি আমার বিদ্বেষ আছে। আমি এই নিয়ে কু-তর্কে যাইনি তবে খানিকটা সতর্ক হয়েছিলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ঢের হয়েছে, বাপু, এই ময়লা নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করব না। আপ্রাণ চেষ্টা থাকত এড়িয়ে যাওয়ার। 
আর কী মুশকিল, কেবল এদের নিয়ে লিখলে অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে লিখব কখন!

আমার স্পষ্ট মনে আছে, ২৪ তারিখের প্রথম আলোর একটা খবর পড়ে দুর্দান্ত ক্রোধে পত্রিকাটা ছুঁড়ে ফেলেছিলাম। নিতান্ত অবহেলায় এদের আঞ্চলিক পাতায় বিশাল বাংলায় ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধির বরাত দিয়ে খবরটা ছাপা হয়েছে:
শিরোনামটা হচ্ছে, "সীমান্ত থেকে পাঁচ শিশুকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ"। এদের মধ্যে একজনের বয়স সাত, আরেকজনের আট!...এ খবর লেখা পর্যন্ত অনুরোধ করার পরও বিএসএফ পতাকা বৈঠকে সাড়া দেয়নি। এদেরকে ছাড়া হয়নি।

আমার মন কি এটা আশা করে বসে ছিল এই বিষয়টা নিয়ে সম্পাদকীয় লেখা হবে? এই নির্বোধ ভাবনা বাড়াবাড়ি রকম আচরণ এটা বুঝি না এমন না। ২৪ জুলাইয়ের পর থেকে এই পত্রিকার সম্পাদকীয় দেখলেই এটা নিশ্চিত হওয়া যাবে কত বড় বড় সমস্যা নিয়ে এরা মাথা ঘামান, এখানে হতদরিদ্র পাঁচ শিশুকে নিয়ে লেখার অবকাশ কই!
১. ২৫ জুলাই: "পোশাকশ্রমিকের জীবন ও মৃত্যু, গণপরিবহনে নৈরাজ্য"।
২. ২৬ জুলাই: "ইউপি-পৌরসভা নির্বাচন, বোর্ডের বই জালিয়াতি।
৩. ২৭ জুলাই: "পবিত্র শবে বরাত, শেয়ারবাজারে বড় দরপতনে আতঙ্ক"।
৪. ২৯ জুলাই: "মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, বন্যার মৃদু পদধ্বনি"।
৫. ৩০ জুলাই: "পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়, সেশনজটের ব্যাধি"।
৬. ৩১ জুলাই: "পোশাকশিল্পের ন্যূনতম মজুরি, অননুমোদিত আবাসন প্রকল্প"।

বেশ, এটা না-হয় মেনে নিলাম কিন্তু আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না, আমাদের পাঁচটা শিশুকে ধরে নিয়ে গেছে, এটা কি অন্তত প্রথম পাতায় আসার মত সংবাদ না? আহা, প্রথম পাতায় জায়গা ছিল না বুঝি? ২৪ জুলাই প্রথম পাতার সংবাদগুলো একটু খতিয়ে দেখা যাক:
১. একজন কর্মকর্তা ঝরনা বেগমকে অস্ত্র হাতে যে পুলিশ মহোদয়গণ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছেন এই পৃথুল ছবির (সাড়ে ছয় ইঞ্চি বাই পাঁচ ইঞ্চি) প্রয়োজনটা কি? খানিকটা ছোট করলে সমস্যা কী ছিল! নাকি এই বিশাল ছবি না দেখলে আমরা বুঝে উঠতে পারতাম না কেমন করে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, তাই না?
২. ফটিকছড়ির শীর্ষ সন্ত্রাসী সেয়াখত নিহত হওয়ার যে বিশদ বর্ণনা দেয়া হয়েছে এই খবর প্রায় সবটুকু প্রথম পাতাতেই পড়তে হবে, না?
৩. মির্জা ফখরুল কি বলেছেন এটা খুব জরুরি, ঠিক না?
৪. "বিশেষ সংসদীয় কমিটিতে যাবে না বিএনপি"। এটাও অতি জরুরি, নাকি?
৫. "প্রাণ জুড়ানো পাখার গ্রাম"। বেশ, মেনে নিলাম এটা জানাবার মত খবর। কিন্তু এর সঙ্গে যে ঢাউস ছবিটা (পাঁচ ইঞ্চি বাই সাড়ে তিন ইঞ্চি) ছাপানো হয়েছে এটা এমন বড়ো করে না ছাপালে আমরা বুঝতেই পারতাম না পাখা জিনিসটা কি? এটা  কেমন করে বানায়?
৬. "মহাখালিতে সাবেক নৌপ্রধানের বাসায় ডাকাতি"। এটা প্রথম পাতায় আসতে পারে কি না এই তর্কে আমি যাব না কারণ ডাকাতিটা কলিমুল্লা, ছলিমুল্লার বাসায় হয়নি। মহাখালিকে খুবই সুরক্ষিত এলাকা হিসাবে ধরা হয়। অনেকে এখানে থাকার জন্য হাঁ করে থাকেন। কিন্তু এই খবরটার সবটুকু আমাকে প্রথম পাতাতেই পড়তে হবে কেন? বাকী অংশটুকু অন্য পাতায় পড়লে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে, না?

ওই দিনেরই পেছনের পাতার প্রসঙ্গ নিয়ে আর আলোচনায় গেলাম না। "চোখ জুড়ানো অর্কিড", এটার যে ছবিটা ছাপা হয়েছে (সাড়ে ছয় বাই পাঁচ)। বড়ো মুখ খারাপ করতে ইচ্ছা করে। পত্রিকার বিশেষ বা...ছাল পাতাগুলো আছে কি করতে?
আর বিজ্ঞাপনের বিষয়ে আলোচনা করে লাভ নেই কারণ টাকা পেলে পত্রিকাওয়ালারা হেন কোন বিজ্ঞাপন নেই [১] যা ছাপে না! এমনিতে তথ্যের ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞাপন না দিয়ে, বিজ্ঞাপনের ফাঁকে তথ্য দিলে আটকাচ্ছে কে?

তবুও এরপর থেকে আমি অপেক্ষা করি এই হতভাগা পাঁচ শিশুর কি হলো? ঠাকুরগাঁয়ের প্রতিনিধিকে সহায়তা করার জন্য ঢাকা অফিস থেকে লোকজন ছুটে যাবেন এটা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি না, যে এই আশায় আমি বসে ছিলাম। ঢাকা অফিসের লোকজন সহজে পেছনটা উত্তোলন করতে চান না এ তো আর নতুন কিছু না। কিন্তু প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকি এই খবরের জন্য এই শিশুরা কি ফিরে আসতে পেরেছিল? ফলোআপ ছাপা হয়েছে কি, নাকি আমার চোখ এড়িয়ে গেছে? আমি এখনো জানি না।

আমি এও বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি, আমাদের দেশের তাবড় তাবড় কলাম লেখক মহোদয়গণ এই নিয়ে টুঁ-শব্দও করেননি। কেন? ফারুক চৌধুরীরা "আফগানিস্তান সমস্যার গোলকধাঁধা" নিয়ে কলম চালিয়ে মানবতার দন্ডটা ধরে রাখেন, না? নিজ দেশের দরিদ্র শিশুদের অন্য একটা দেশ ধরে নিয়ে গেলে গায়ে লাগে না, না? কারণ এই খবরগুলো আঞ্চলিক খবর, এই খবরগুলো কাভার করবেন, লিখবেন আঞ্চলিক প্রতিনিধি। বড় বড় মানুষদের বয়েই গেছে আঞ্চলিক খবরে চোখ বুলাতে।
সো কলড মুক্তচিন্তার ধারক-বাহক, এই সব পত্রিকা যারা চালান এরা কবে বুঝবেন কোন তথ্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, মানবিক। হা মানবতা, যা আমাদের দেশে কেজি দরে বিক্রি হয়...।
আজ এই বাচ্চাগুলোর জায়গায় যদি কেবল একজন ইউনিফর্মধারী কেউ হতো গোটা দেশব্যাপি ঝড় বয়ে যেত। রাজনীতিবিদদের গলাবাজিতে গলা বসে যেত, আমাদের তথাকথিত সুশীলদের কলমের কালি শেষ হয়ে যেত।
আমাদের লিখিত সংবিধানে যেমন প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সমান অধিকার রাখা হয়েছে তেমনি অলিখিত 'মিডিয়া-সংবিধানে'ও প্রত্যেকের বেলায় সমান গুরুত্ব দেয়া হবে এটাই যথার্থ আচরণ, এর ব্যত্যয় হওয়ার কোন সুযোগ নাই। 

*২ আগস্ট, ২০১০: 
এই পাঁচ শিশুর পরে কি হলো এটা জানার জন্য প্রথম আলোর পুরনো একটা ডায়েরিতে দেয়া নাম্বারের সূত্র ধরে ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধির যে নাম্বার দেয়া আছে, ওটায় ফোন করি। ওই নাম্বারটা এখন আর ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধির না। জনাব লতিফ নামের একজনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বিস্তারিত জানার জন্য ইউএনবিনিউজ ডট কমের কথা বলেন। সমস্যাটা কোথায় জানি না, এই ঠিকানায় বিজাতীয় এক সাইটের খোঁজ পেলাম। আমি আবারও ফোন করি, সমস্যার কথা বলি। তিনি সমাধান দিতে পারলেন না। তিনি বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডট কমে খোঁজ করতে বলেন। এখানেও খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হই।
ফোন করি প্রথম আলো অফিসে। বার্তা বিভাগের জনাব রুবেলের সঙ্গে কথা বলি। তিনিও এই তথ্যের বিষয়ে গুছিয়ে বলতে পারেননি। আমাকে সাড়ে চারটার পর চীফ রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। সাড়ে চারটার পর অনেকবার চেষ্টায়ও চীফ রিপোর্টারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি।

অবশেষে ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধির জনাব মুজিবর রহমানের নাম্বার যোগাড় হয়। তিনি জানান, ২৭ তারিখে ফলোআপ ছাপা হয়েছে 'সারাদেশ' নামের আঞ্চলিক পাতায়। আমি তন্নতন্ন করেও খুঁজে পাই না। তিনি জানান, হয়তো নগর সংস্করণে না ছেপে অন্য কোন সংস্করণে ছাপা হয়েছে।
তো, তাঁর কাছে যেটা জানতে পারি, বিএসএফ এদের ফেরত দেয়নি। ওদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। এরা বলার চেষ্টা করছে ৩জন ব্যতীত অন্যরা প্রাপ্তবয়স্ক। এ মাসের ৫ তারিখে এদেরকে কোর্টে তোলা হবে। এটা অবশ্য জনাব লতিফও জানিয়েছিলেন।
এখন অবশ্য বিবিসি বাংলার লিংকটা পেয়ে অনেকখানি আঁচ করা গেল [২]

সহায়ক লিংক:
১. সম্পাদক: http://www.ali-mahmed.com/2007/06/blog-post_7364.html
২. বিবিসি: http://www.bbc.co.uk/bengali/news/2010/07/100725_tbbdindiaborder.shtml   

3 comments:

সুব্রত said...

আহা রে, আনিসুল হক! মহামান্য উপসম্পাদক! কত অরণ্যেই* না তাঁকে রোদন করতে হয়! কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শেষ হয়ে গেছে বুঝি? এই পাঁচ শিশুর জন্যে কাঁদবার একফোঁটা অশ্রু ছিল না, না?

গা-বাঁচানো এই কাপুরুষদের কথা কী আর বলব! তেমনি দুঃখ লাগে গা-বাঁচানো মন্তব্যকারীদের দেখে। যেখানে ব্যক্তিগত ক্যাঁচালের গন্ধ আছে, এরা সেখানে আছেন ঘি ঢালতে, তবু এরকম একটা ইসু নিয়ে ব্লগ লিখলে তাদের কাউকেই দেখা যায় না এলাকায়। দু'দলের মাঝে কোন পার্থক্য আছে কি, আদতেই? অপেক্ষায় ছিলাম, কে প্রথম মন্তব্য করেন। দশদিন পেরোনোর পর এই সিদ্ধান্তে আসতে হলো, এই অধমই এই ব্লগের প্রথম মন্তব্যকারী। আমার কি গর্ব করা উচিত? :(

* 'অরণ্যে রোদন' আনিসুল হকের একটা নিয়মিত কলামের নাম।

আলী মাহমেদ - ali mahmed said...
This comment has been removed by the author.
আলী মাহমেদ - ali mahmed said...

"দশদিন পেরোনোর পর এই সিদ্ধান্তে আসতে হলো, এই অধমই এই ব্লগের প্রথম মন্তব্যকারী। আমার কি গর্ব করা উচিত? :( "
মন থেকেই বলি, অবশ্যই। @সুব্রত