Search

Wednesday, August 5, 2009

আমরা দুধ বিক্রি করে শুটকি খাওয়া জাতি

বকুল আক্তার (দুলা মিয়ার সেই মেয়ে)
মুক্তিযোদ্ধা দুলা মিয়াকে (link)নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম।
এই অসমসাহসী বে-সামরিক মানুষটার সাহস দেখে সামরিক লোকজনরা পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি সাবেক সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ পর্যন্ত!
যুদ্ধে এই মানুষটার নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গিয়েছিল। গামছা দিয়ে বেঁধে গুলির পর গুলি চালিয়েছেন, পিছ-পা হননি।


একজন মানুষের এমন সাহস রগরগে মুভিকেও হার মানায়! অথচ আমাদের দেশে নাকি ভাল স্ক্রিপ্টের অভাব! মানুষটা যুদ্ধে গিয়েছিলেন তাঁর ছোট্ট মেয়েটির তাগিদে। পরবর্তীতে এই মেয়েটির সম্বন্ধে কোথাও কোন তথ্য পাইনি। কিন্তু খুব ইচ্ছা করছিল মেয়েটির সম্বন্ধে জানার। সেই ছোট্ট মেয়েটি এখন কেমন আছেন- কেমনই বা আছেন দুলা মিয়া নামের সিংহবলোকনন্যায় মানুষটা?


দুলা মিয়া বলেছিলেন, তিনি কুমিল্লার শালদানদিতে থাকেন। কিন্তু শালদানদি তো বিশাল এলাকা এবং পাহাড়ি অঞ্চল। কোথায়-কোথায় খুঁজব? তবুও বেরিয়ে পড়ি।
শালদানদির কেউ কিচ্ছু জানে না এই মানুষটা সম্বন্ধে। ‘অষ্টজঙ্গল’ নামের একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছি। নামের মতই জায়গা, ঝোপ-জঙ্গলের অভাব নাই! একজন মসজিদ রং করছিলেন, তিনি চিনতে পারলেন, 'আরে ওই ভটলা (মোটা) মানুষটা'।
মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অপমানসূচক কোন মন্তব্যে এখন আর অবাক হই না। তবুও এখন এই কথাটা বুকে ধক করে লাগে, চোখ ভিজে আসে। এমন একজন মানুষের এমন পরিচিতি, তাঁর প্রতি এই অশ্রদ্ধা- হা ঈশ্বর! এলাকার লোকজনরা জানেই না এই মানুষটা দেশের জন্য কী করেছেন! কেন এদের জানানো হয়নি, এই দায় অবশ্যই আমাদের উপর বর্তায়। 
অনেক চেষ্টায় তাঁর কবর নামের যে স্থান খুঁজে বের করি, নামফলক দূরের কথা কোন সামান্য চিহৃও নাই। এটা এবং জঙ্গলের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। অথচ পাশেই কোন এক অখ্যাত ফকিরের সমাধি দস্তরমতো টিন-ছনের ঘর বানিয়ে লালশালু দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। ভাগ্যিস, মখমল দিয়ে যে মুড়িয়ে রাখা হয়নি!
যে দেশের যে দস্তুর- এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। আমরা দুধ বিক্রি করে শুটকি খাওয়া জাতি, আমাদের আচরণে এর ব্যত্যয় হবে কেন? আমরা অসভ্য না হলে এমন একজন অগ্নিপুরুষকে এমন অবহেলায় ফেলে রাখব কেন? আর কেনই বা এক অখ্যাত ফকিরের সমাধি মাথায় তুলে রাখব! এখন (১৬ ডিসেম্বর, ২০০৯) এই ফকিরের সমাধি পাকা করা হচ্ছে, ক্রমশ জৌলুশপূর্ণ হবে। 

কিন্তু তাঁর সেই ছোট্ট মেয়ের খোঁজ কেউ দিতে পারে না। কেউ বলল, এরা এখান থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঢাকায় চলে গেছে। ভাগ্যক্রমে খোঁজ পাওয়া যায়, তিনি নাকি বেড়াতে এসেছেন। অবশেষে সেই মেয়েটির মুখোমুখি হওয়া। বকুল আক্তার নামের সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ আর ছোট্ট নাই, অকালে বুড়িয়ে গেছেন। যুদ্ধের সময়কার কোন স্মৃতিই আজ আর তাঁর মনে নাই। তাতে কিছুই যায় আসে না- আমাদের তো মনে আছে। এও কী কম পাওয়া?
কিন্তু বারবার ঘুরেফিরে যে কথাটা বলছিলেন:
'আমার কোন টাকা-পয়সার দরকার নাই। আমার বাপেরে একটা খেতাব দিল না ক্যান? তাইনে কী দেশের লাইগা যুদ্ধ করে নাই'?
আমি আকাশপানে তাকিয়ে থাকি- একজন নপুংসক আর কী-ই বা করতে পারে...। আমার কাছে অসংখ্য প্রশ্নের মতো এটারও কোন উত্তর নাই! কতশত প্রশ্ন, এর উত্তর কে দেবে?
বীরশ্রেষ্ঠদের মধ্যে একজনও সিভিলিয়ান নাই, কেন?
একজন কমান্ডো মুক্তিযোদ্ধা ঠেলা চালান, কেন? 
আমি অতি সামান্য মানুষ হয়েও দুলা মিয়ার সেই ছোট্ট মেয়েটির খোঁজ এত বছর পরও বের করতে পারলে, এই দেশের দুর্ধর্ষ মিডিয়া ভাইয়ারা বেসুমার টাকা, হাতি-ঘোড়া থাকার পরও দুলা মিয়াকে খুজে বের করতে পারলেন না, কেন?
যে জজ সাহেব, পাকিস্তান আর্মির হাতে তার প্রতিবেশীর ফুটফুটে মেয়েকে তুলে দিয়েছিল সেই জজ সাহেবের খোঁজ আজ-অবধি বের করতে পারলেন না, কেন? একজন মুক্তিযোদ্ধা আত্মহত্যা করার জন্য ১৬ ডিসেম্বর বেছে নেন, কেন? তাঁর লাশ ১২ ঘন্টা গাছে ঝুলে থাকবে, কেন
বীরাঙ্গনা রিনার এইসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে, ওই মানুষটা আজ কোথায়? আমরা জানি না, কেন?
আসলে কালে-কালে মুক্তিযুদ্ধের আবেগে এখন একটি পণ্য!

(এখানে বীরপ্রতীক আলমগীর সাত্তারের বক্তব্যটা প্রাসঙ্গিক বিধায় তুলে দিচ্ছি:
'...খেতাব দেয়ার সময় কেন এত কার্পণ্য করা হল? খেতাবপ্রাপ্তদের বেলায় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সংখ্যাই বেশী এবং এটাই স্বাভাবিক। কারণ সামরিক বাহিনীর সদস্য যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলেন, তাদের প্রশিক্ষণ ছিল পর্যাপ্ত। এরপরও আমি বলব, বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধারাই খেতাব পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বেশী। খেতাবপ্রাপ্তির ব্যাপারে সুপারিশ করার মত যাঁরা উচ্চপদে আসীন ছিলেন, তাদের অবহেলার কারণেই হয়েছে এমনটা।
...তবে ব্যতিক্রমি সেনানায়ক ছিলেন মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চীফ অভ স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার। তার মত উদার যদি অন্য সেক্টর কমান্ডাররা হতেন, তাহলে অবশ্যই খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা অনেক বেশী হত। অনেক সেক্টর কমান্ডারই মনে হয় বুঝতে পারেনি যে, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ বারবার হয় না...।')
সহায়ক সূত্র:
১. চাউল বিক্রি করে কফের সিরাপ খাওয়া...: http://www.ali-mahmed.com/2009/12/blog-post_16.h
tml
*আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই: দুলাল ঘোষ, সোহরাব হোসেনকে।
**ঋণ: 'দুধ বিক্রি করে শুটকি খাওয়া জাতি' এই বাক্যটা বলেছিলেন মাহাবুব আহমাদ। বাক্যটা ঠিক তাঁরও না, তাঁর বাবার। তিনি তাঁর বাবার মুখে শুনেছিলেন।
***দুলা মিয়ার একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন এইচ এম. ইকবাল। ****Ripon Majumder আজই জানালেন, এইচ. এম. ইকবাল-এর সাক্ষাৎকারের এই লিংকটা কাজ করছে না (মানুষটার প্রতি কৃতজ্ঞতা, নইলে আমার জানাই হতো না)। বাস্তবেও দেখছি তাই- এটা তিনি যেখানে লিখেছেন সেখানকার সমস্যা! কারও লিংক ধরে পাঠক পড়বেন এটাই নিয়ম। কিন্তু এখানে এটা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক চেষ্টার পর এই লেখাটি উদ্ধার করা গেছে।
এই সাক্ষাৎকারটি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে এটাকে হারাতে দেয়া চলে না। জনাব, এইচ. এম. ইকবাল-এর কাছ থেকে অনুমতি নেয়ার কোনো উপায় আপাতত দেখছি না তাই নিরুপায় হয়ে এইচ. এম. ইকবাল-এর নেয়া এই সাক্ষাৎকারটা এখানে যোগ করছি এইচ. এম. ইকবাল-এর নেয়া এই সাক্ষাৎকার:
"নাম : দেলোয়ার হোসেন দুলা মিয়া
গ্রাম : অষ্টজঙ্গল
ডাক : সালদা নদী
ইউনিয়ন : বায়েক
থানা : কসবা
জেলা : ব্রাহ্মণবাড়িয়া
১৯৭১ সালে বয়স : ২৮/২৯
১৯৭১ সালে পেশা : মুজাহিদ বাহিনীর সদস্য
বর্তমান পেশা : অসুস্হ অবস্হায় পঙ্গুত্ব জীবন যাপন।
মুজাহিদ বাহিনীর সদস্য দেলোয়ার হোসেন দুলা মিয়া ছিলেন পাকিস্তানিদের ত্রাসহরসপুর,মনতলা, মাধবপুর,জগদীশপুরসহ ২৭টি অপারেশনে অংশ নিয়ে প্রতিটিতেই সাফল্য অর্জন করেছেন তিনিপাকিস্তানিদের গুলিতে দুলা মিয়ার নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে পড়লেও তিনি তাঁর মাথায় বাঁধা কালো কাপড় দিয়ে কোনো রকমে পেট বেঁধে একাই একটি মাত্র হালকা মেশিনগান দিয়ে পাক অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন
প্র: ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাত্রে পাকবাহিনীর হামলার পর আপনি কি করলেন? 
উ: ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত্রে পাকবাহিনী ঢাকার রাজারবাগ,কুমিল্লা পুলিশ লাইন ইত্যাদি স্হানে আক্রমণ করেআমরা কিন্তু পরদিন ঘুম থেকে উঠে কিছুই জানতে পারি নাইসকাল বেলা যখন আমরা সালদা নদী স্টেশনে বসে আমি তখন দেখলাম দুইজন পুলিশ কাপড় গায়ে নাই শুধু হাফপ্যান্ট পরা আসতেছেতখন জিজ্ঞাসা করলাম ভাই আপনারা কারা? উত্তর দিল ভাই আমরা পুলিশকুমিল্লা পুলিশ লাইন থাইকা ভাইগা আসছিআমাদের পুলিশ লাইনে কোনো লোক আছে বইলা মনে হয় নাওরা শেষ হইয়া গেছেআমাদের উপর আক্রমণ করেছেতখন আমরা নিকটস্থ সালদা নদী ই.পি.আর ক্যাম্পে যাইয়া বাঙালি যারা ছিলেন তাদের কাছে বললাম যে এখন আর বসে থাকার সময় নাইএখন কাজ প্রয়োজনতখন তারা বলল যে আমাদেরকে সহযোগিতা করেন
এইখানে তিনজন অবাঙালি সৈন্য ছিলআমরা তাদেরকে মেরে ফেলিকালিন ইপিআরের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন সুবেদার আতাউর রহমান চৌধুরীউনার বাড়ি ছিল সিলেটউনার নেতৃত্বে তখন আমরা বড়জোলা হয়ে মতিনগর দিয়া ইন্ডিয়াতে উঠিওখান থেইকা ট্রাকযোগে আমরা তেলিয়াপাড়া চলে যাইমেজর সফিউল্লাহ সাব তখন ২য় বেঙ্গলের কমান্ডারআমরা ৭/৮ জন উনার সাথে যোগ দেইঐখানে যাইয়া আমরা সেকেন্ড বেঙ্গলের সাথে জড়িত হইয়া যাইসেখান থেকেই আমরা লড়াই শুরু করি
তারপরে আমরা চলে যাই ব্রাহ্মণবাড়িয়াএরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে চলে যাই আশুগঞ্জ,আশুগঞ্জ থেকে চলে যাই লালপুর বাজারসেখানে যাইয়া আমরা পাঞ্জাবিদের একটি লঞ্চ ধ্বংস করিতারপরে আমাদের উপর বিমান অ্যাটাক হয়সারাদিন বিমান অ্যাটাক হওয়ার পর সন্ধ্যাবেলা আমরা আবার ফিরে আসিআইসা আবার আমরা মাধবপুর ডিফেন্সে চইলা যাই

প্র: ১৯৭১ সালে আপনি আক্রান্ত হয়েছিলেন কি?
উ: ১৯৭১ সালের জুন অথবা জুলাই মাসের মধ্যেই আমি হরসপুর এবং মনতলার মাঝামাঝি ডেলটা কোম্পানিতে ছিলামআমার কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন লে: হেলাল মোরশেদহরসপুর রেলস্টেশনের পশ্চিম দিকে একটি বাজার আছেসেই বাজার থেকে আমরা গেছিলাম পাকবাহিনীর যে ঘাঁটি ছিল সেখানে আক্রমণ করার জন্যআমরা যাওয়ার আগেই রাজাকার যাইয়া ওদেরকে খবর দিল যে মুক্তিবাহিনীরা আসতেছে আক্রমণ করবেএখবর আমরা জানি নাতখন তারা যেখানে ছিল সেখান থেকে দূরে সরে যায়ঐখানে তাদেরকে আমরা আর পাই নাইরাতারাতি পাকিস্তানিরা আমাদের পিছন দিকে হরসপুর স্টেশনের দুইদিকে,হরসপুর মনতলার মাঝামাঝি দিয়ে এডভান্স হইর এক কোম্পানি,অন্যদিকে হরসপুর এবং মুকুন্দপুরের মাঝামাঝি দিয়েও এক কোম্পানি এডভান্স হয়ে গেল
ভোর রাত্রে যখন আমরা লক্ষ্য করলাম যে আমাদের উপর হয়তো কাউন্টার অ্যাটাক হইতে পারে তখন আমরা পিছু হটে আসিতখন আমি আমার কোম্পানির ডান দিকে ছিলামযখন রায়গঞ্জে পৌঁছি তখন আমার হাতে ছিল একটা হালকা মেশিনগানআমি মেশিনগান নিয়া ঐখানে এক ঝোঁপের ভিতর বসে থাকি
এমন সময় দেখি পাকবাহিনী আমার ১০০ গজের মধ্যে আইসা পড়ছেতখন আমি ভাবলাম যে এখন যদি আমি গুলি না কইরা চলে যাই তাইলে আমার কোম্পানিটা পুরা উড়ে যাবেতখন মনে করি যে আমি মরে যাই তবু কোম্পানি বেঁচে থাকতখন আমি ফার্স্ট ফায়ার করিআমার ফায়ারের সাথে সাথে যারা আমার সামনে ছিল ৭/৮ জন তারা সব শেষ হয়ে গেছেতখন ঐখান থেইকা তারা গোলাগুলি আরম্ভ করলোদুই ঘন্টার মতো গোলাগুলি চলেআমার কোম্পানি গোলাগুলির আওয়াজ শুনে একটু বাম সাইডে যাইয়া ইন্ডিয়ার দিকে চলে যায়
পাক সৈন্যরা আমাকে তখন তিনদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলেঘেরাও করে তারা আমাকে ধরার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেআল্লারই হুকুম আমারও জান বন্ধ হয় নাইধরতে পারে নাইতখন আমার বাম সাইড থেইকা গুলি আইসা আমার পেটে লাগেপেটের নাড়িভুড়ি বেশ খানিকটা বেরিয়ে যায়তখন তো আমার মাথায় একটি কালো কাপড় ছিলসে কাপড় দিয়ে পেটটা বেঁধে ফেলিতারপর গুলি চালাতে থাকি একাতারা আর এগুতে পারে নাই এবং পিছু হটে যায়তখন সকাল অনুমান সাড়ে ৮টার সময় আমার মনে হয় সেক্টর কমান্ডার মেজর সফিউল্লাহ সাহেব নিজেই গাড়ি নিয়া আসেন এবং বললেন যে,
'এইখানে ফায়ার করেছে কে? মোরশেদ, তোমার কোম্পানিতে কে নাই'?
তিনি বললেন, 'দুলা মিয়া নাই'
তখন আমাকে খোঁজার জন্য সফিউল্লাহ সাহেব লোক পাঠায়এসব আমি পরে শুনছিতখন উনি সহকারে আসেনআইসা উনি আমার পাশে দাঁড়ানতাঁকে দেখেই আমার শরীরটা দুর্বল হয়ে যায়তখন আমাকে নিয়ে যায় এবং চিকিসার ব্যবস্হা করে

প্র: আপনি কেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন?
উ: আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি এই জন্য যে আমরা বাঙালি,আমরা যুগে যুগে বাঙালিকিন্তু কোনদিনও আমরা বাঙালিরা ক্ষমতায় বসতে পারি নাইআমরা বাঙালি জাতি হিসাবে পৃথিবীতে বেঁচে থাকবো এবং বাঙালি হিসাবে সারাবিশ্বে আমরা প্রতিষ্ঠিত হব এবং ভবিষ্য প্রজন্ম যারা আসবে তারা যেন স্বাধীন বাঙালি জাতি হিসাবে পরিচিত হইতে পারে এবং স্বাধীন জাতির পতাকা তুলে তারা দাঁড়াইতে পারে সেইজন্য আমরা যুদ্ধ করেছি

প্র: যুদ্ধ চলাকালীন সময় আপনার কোনো মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ে কি?
উ: যুদ্ধ চলাকালে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথা একটাই মনে পড়েআমার গুলি লাগছে সেটাও আমি মর্মান্তিক মনে করি নাআমার তকালীন সহকারী এক সৈনিক ছিলতার নাম ছিল তাহেরতার বাড়ি হইল আমার বাড়ির পাশে মাদলাতার বাবার নাম হইল আবদুল মজিদথানা কসবাপোস্ট অফিস সালদানদী এবং জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়াসে আমার সাথে ছিল
আমার মাধবপুর থেকে আইসা জগদীশপুর আবার ডিফেন্স নেইমাধবপুরে সকাল থেকে ১২টা পর্যন্ত লড়াই করার পর আমরা টিকতে পারি নাইপাল্টা আক্রমণ করার মতো আর হাতিয়ার আমাদের কাছে ছিল নাতাই ১২টার সময় আমরা পিছন দিকে হটে আসিআইসা আমরা জগদীশপুরে ডিফেন্স নেইতখন সন্ধ্যাবেলা আমাদের এমুনেশন ছিল নাআমরা তাহেরকে এবং সেকেন্ড বেঙ্গলের ড্রাইভার গফুরকে ডেকে পাঠাইলাম যে তোমরা এমুনিশন এবং কিছু মর্টারের গোলা নিয়া আসতখন তারা রাত্র প্রায় ১১ টার দিকে তেলিয়াপাড়া থেকে ৫০টা দুই ইঞ্চি মর্টারের গোলা এবং ৫০০০ রাউন্ড গুলি নিয়া আসতেছিল
কিন্তু তেলিয়াপাড়া থেইকা মন্ত্ররা রোড হয়ে সুরমা গ্রামের হারুলিয়া সেতুর নিকটে আইসা গাড়িটা খুঁটির সাথে ধাক্কা লাইগা উল্টে যায়উল্টে যাওয়ার পরে ড্রাইভার গফুর গাড়ি থেইকা লাফ দিয়ে পড়ে যায় এবং তাহের পড়ার সাথে সাথে তার একটা হাত গাড়ির নিচে চাপা পড়েতখন গফুর গ্রামবাসীর ডাক দিলে তারা বাতি নিয়া আসলোসে বললো যে আপনারা গাড়ির কাছে আসবেন নাকেননা গাড়ির ট্যাঙ্কির পেট্রোল মাটিতে পড়ে গেছেআপনারা বাতি দূরে রাখেন
যেখানে গাড়িটা উল্টে পড়ছে সেদিকটা ছিল একটু তেরছা ঢালুঢালু জাগাতে পেট্রোল ভাইসা আইসা একটা নালা আছিল সেই নালা দিয়া পেট্রোলগুলা আসতাছেএদিকে ঐ গ্রামের লোকগুলা ওখান থেইকা মনে করেন বিশ গজ দূরে ঐ নালার যে আইল ছিল সেই আইলের পাশে মশাল বাতিটা রাইখা আসতাছেএই সময় পেট্রোল নিচ দিয়া যাচ্ছেহঠা ঐ পেট্রোলে আগুন লাইগা যায়আগুন ধইরা যাবার সাথে সাথে ঐ পেট্রোল যেভানে যেদিক দিয়া আসছে সেই দিক দিয়া একদম গাড়ির কাছে চইলা গেছেগাড়ির কাছে চইলা যাবার পর তখন গাড়িতে আগুন ধইরা যায়তখন পাবলিক দূরে সরে যায়
গাড়িটা আগুনে পুইড়া ছারখার হইয়া গেল এবং সেই সাথে তাহেরও মর্মান্তিকভাবে মারা গেলতার হাত পাগুলা বাঁকা হইয়া একসাথে হইয়া গেছেএই ধরনের ঘটনা পুরা নয় মাসের যুদ্ধে আমি দেখিনিবহুত লাশ আমি টেনেছিকিন্তু এই ধরনের ঘটনা আমি আর দেখিনিআমি ২৭ টি অপারেশনে অংশ নিয়েছি প্রতিটিতে সাকসেসফুল হয়েছি

প্র: তখন আপনার কমান্ডার কারা ছিলেন?
উ: আমার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর সফিউল্লাহ সাহেবতারপরে নাসিম সাহেব ছিলেন তারপর হেলাল মোরশেদ,সুবেদ আলী ভূঁইয়া,ক্যাপ্টেন মতিন উনি ছিলেনএরপর ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ছিলেন

প্র: তখন মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে জনগণের মনোভাব কি ছিল?
উ: তখন জনগণ মুক্তিবাহিনীর খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করছেস্বাধীনতার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেমুক্তিবাহিনী সম্পর্কে জনগণের মনোভাব খুবই ভাল ছিল

প্র: আপনার গ্রাম বা এলাকায় কারা রাজাকার ছিল?
উ: আমার গ্রামে রাজাকার ছিল নাতবে মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তানের সাপোর্টার কিছু ছিলতারা তেমন একটা ক্ষতি করে নাইতখন তাদের দ্বারা উপকারও হয়েছেতারা অনেক লোককে বাঁচাইয়াও আনছেযদিও রাজাকার শব্দটা খারাপ তবে সব লোক কিন্তু খারাপ কাজ করেনি

প্র: যুদ্ধের শেষে গ্রামে ফিরে কি অবস্থা দেখলেন?
উ: ১৬ই ডিসেম্বরতো আমরা স্বাধীনতা পেলামডিসেম্বরের ২৭/২৮ তারিখের দিকে সালদা নদী আসছিআইসা তখন সালদা নদীর অবস্হা দেখলাম যে বাড়িঘর দরজা যা ছিল জ্বালাই পুড়াই ছারখার করছেব্রিজ যা ছিল সব ভাইংগা ফেলছেমসজিদ, মন্দির সবগুলা তারা চুরমার করে দিয়েছে

প্র: আপনার অস্ত্র কি করলেন?
উ: আমি তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসছিআইয়া মতিন সাহেবের কোম্পানিতে ছিলামমতিন সাহেব ছিলেন এইখানেতারপর হায়দার সাহেব ছিলেন ফোর বেঙ্গলেহায়দার সাহেব তখন কুমিল্লার কোর্টবাড়িতে ১৩ বেঙ্গল রেজিমেন্ট তৈরি করেনতখন উনি মতিন স্যারকে জানাইলেন যে এখান থেইকা এক কোম্পানি লোক আমাদের দিতে হবেমতিন সাহেব বললেন যে তোমরা কোর্টবাড়ি চলে যাওতখন আমরা এক কোম্পানি লোক কোর্টবাড়ি যাইয়া ১৩ বেঙ্গল খাড়া করাইঅস্ত্র আমাদের সাথেই ছিল১৩ বেঙ্গলে রইলাম আমরা

প্র: যুদ্ধের শেষে আপনি কি করলেন?
উ: যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ১৩ বেঙ্গলে গেলাম১৩ বেঙ্গলে যাওয়ার পর কিছু দিন ঐখানে চাকরি করলামসর দুয়েক করলামকরার পরে আর ভাল লাগে নাআমার হাত-পা তো গুলিতে বিধ্বস্ততখন পিটি প্যারেড করতে, চলতে ফিরতে মনমানসিকতা তেমন ভালো ছিল নাতখন বাড়িতে চলে আসি

সাক্ষাকার গ্রহণকারীর নাম : এইচ. এম. ইকবাল
সাক্ষাকার গ্রহণের তারিখ : ২৫ আগস্ট ১৯৯৬
ক্যাসেট নম্বর : কসবা ৪"

12 comments:

Sadiq said...

This is very valuable work Shuvo bhai.

Emon said...

Shuvo bhai, apnake salam.

Anonymous said...
This comment has been removed by a blog administrator.
Anonymous said...
This comment has been removed by a blog administrator.
bashirctg said...
This comment has been removed by a blog administrator.
bashir said...

Shuvo bhai, apnake salam.

sadia said...

Shuvo bhai, thanks

আলী মাহমেদ - ali mahmed said...

ধন্যবাদ, ভাল থাকুন @Emon
আপনিও ভাল থাকুন @bashir

আপনাকেও ধন্যবাদ পড়ার জন্য @sadia

Sumit said...

Thanks for such useful information

Pankaj said...

good work! keep it up

yogesh said...

Very nice blog. Keep up the good work

Josh said...

It was really tough for me to understand.I translated and read it. I find the information very helpful.Thanks. IGNOU Solved Assignments